ফের বাড়ছে পেঁয়াজের দাম, নেপথ্যে কী?

মসলার বাজারে আবারো আলোচনায় পেয়াঁজ। তিন শতক পেরিয়ে যাওয়া পেঁয়াজের মূল্য যখন দশক দুইয়ে নেমে আসে, তখন ঝাঁঝটাও যেন সইয়ে নিতে পারছিলেন ক্রেতারা। দুই ঈদ পাড়ি দিয়ে এসে পেঁয়াজ আবার গর্বে বুক ফুলাচ্ছে, বাজারে তার দাম আবারো ৫০ টাকা পেরিয়েছে। ক্রেতারা উদ্বিগ্ন, এবার পেঁয়াজের মূল্য কোথায় গিয়ে থামে? পেঁয়াজের এই পারফরমেন্সের পেছনে কলকাঠি নাড়ছেন কারা? উত্তরে নাম চলে আসে চট্টগ্রামের পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জের।

দুই বর্গমাইলের এ বাজারে ৫ হাজরের বেশি আড়ৎ রয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর ও স্থলবন্দর থেকে সব ধরণের পণ্য প্রথমে এখানে আসে বলেই ব্যবসায়ীদের কাছে এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ খাতুনগঞ্জ। আরো বেশি পরিচিত পেঁয়াজসহ কাঁচা মালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে এখানকার দুই’শোর বেশি আড়ৎ। গত বছর ২৯ সেপ্টেম্বর ভারত পেয়াজ রপ্তানি বন্ধে লাগামহীনভাবে বেড়ে কেজি সাড়ে তিন’শো টাকায় বিক্রি হয় এখানে। এবার আবারো শুরু পেঁয়াজ নিয়ে অস্থিরতা। কেন পেঁয়াজের বাজার বারবার অস্থির হয় তার অনুসন্ধানে নামে সময় টিভি। অনুসন্ধানের বের হয়ে আসে চারটি কারণ।

প্রথমত, বছরে দেশে ৩৪ থেকে ৩৫ লাখ মেট্রিকটন পেঁয়াজের চাহিদা। ২৪ থেকে ২৫ মেট্রিকটন দেশে উৎপাদিত হলেও আমদানির করতে হয় ৯ থেকে ১০ লাখ। আমদানির পুরোটাই নির্ভর করে ভারতের ওপর। মহারাষ্ট্রের নাসিক আর ব্যাঙ্গালোর সাউথে পেঁয়াজে সংকট হলে তার প্রভাব পড়ে সরাসরি দেশের বাজারে। হু হু করে বাড়তে থাকে দাম। গত বছর ভারত রপ্তানির বন্ধের সিদ্ধান্তে বেড়েছিল। আর এবার বেড়েছে সাউথে বন্যার কারণে। এতে স্পষ্ট কতটা ভারত নির্ভরতা!

পেঁয়াজের বাজার অস্থিরতার আরেকটি কারণ ভোমরা, সোনামসজিদ, হিলি ও বেনাপোল স্থলবন্দরে থাকা আমদানিকারক আর দালালদের সিন্ডিকেট। প্রতিদিন দেড়’শোর বেশি ট্রাকে করে দেশে পেঁয়াজ ঢুকে আড়াই হাজার টনের বেশি। আমদানিকারকরা ৫০ পয়সা কমিশনে ভারতের রপ্তানি কারকদের কাছ থেকে আনে। আবার ৫০ পয়সা কমিশনে বিক্রি করে দালাদের কাছে। কিন্তু কমিশনের বাইরে আমদানিকারক ও দালালদের সিন্ডিকেট বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করে।

সিন্ডিকেট চক্রে হিলি স্থলবন্দরে শহিদুল ইসলাম, বাবলু, সাইফুল, মোবারক, নাজমুল ও মনোয়ারসহ ১০ থেকে ১২ জন বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। আর সোনা মসজিদে তাজেল মেম্বার, পলাশ, আজিজুল, জহুরুল ও আবু সাইদসহ ১০ থেকে ১৫ জন। এছাড়া ভোমরায় ফিরোজ, শাহীন, সাদ্দাম, আলমগির, হাসান ও সাইদসহ ১০-১৫ জন। এরাই মূলত বাংলাদেশের পেঁয়াজের আমদানির পুরো বাজার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

এবার আসি চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ। এখানে পেপারলেস মার্কেট ও কমিশন ব্যবসাকে দায়ি করা হয় পেঁয়াজের বাজার উর্ধ্বমুখীর জন্য। স্থলবন্দরগুলো থেকে কমিশনে এনে বিক্রি করে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে ২’শ এর বেশি আড়তদার। মূলত এখানে চলে কমিশন বাণিজ্যের আড়ালে অন্যরকম কারসাজি। যাকে বলে পেপারলেস মার্কেট। আমদানি কাগজপত্র বা ক্রয়ের রশিদ ছাড়াই ব্যবসা। ফলে ইচ্ছেমতো যখন তখন বাড়ানো যায় দাম। কমিশন পদ্ধতিতে লাভ হলেও নেই কোনো ক্ষতি।

কমিশনের বাইরে খাতুনগঞ্জে চট্টগ্রাম বাণিজ্যালয়, নিউ বার আউলিয়া, খাতুনগঞ্জ ট্রেডিং, হক ট্রেডার্স, একতা ট্রেডিং ও মেহের ট্রেডার্সসহ বেশকিছু আমদানিকারক পেঁয়াজ আমদানি করে। তবে তারা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। এবার পেঁয়াজের দাম বাড়লে কমিশন এজেন্টদের জরিমানা করে জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত। কারণ তারা আমদানির কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারনি। এর প্রতিবাদে রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে আন্দোলনের করে খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা।

আর এ কমিশন পদ্ধতিকে অবৈধ উল্লেখ করে ক্যাব আর ভ্রাম্যমাণ আদালত বলছেন, এটা মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের পুরনো কৌশল।

এবার নজর দেয়া যাক দেশি পেঁয়াজ চাষি ও উৎপাদনের দিকে। মেহেরপুর, পাবনা, ফরিদপুরসহ দেশের নানা এলাকার কৃষকরা যখন দেশীয় মুড়িকাটা আর হালি পেঁয়াজ বাজারে তোলে। ঠিক তখনই ভারত কৌশলে কমিয়ে দেয় পেঁয়াজের দাম। ফলে দেশীয় কৃষকরা পুঁজি হারিয়ে ক্ষতির মুখে পড়ে। হতাশ আর নিরুৎসাহিত হয়ে কমিয়ে দেয় চাষ। ফলে পেঁয়াজের বাজার আরো বেশি নির্ভর হয়ে পড়ে ভারতের ওপর।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্ত, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এবং টিসিবি কোন সংস্থার কাছে নেই দেশের পেঁয়াজের উৎপাদন ও চাহিদার সঠিক তথ্য। যে কারণে অন্ধকারেই থেকে যায় পেঁয়াজের হিসাব-নিকাশ।



Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked as *