পাশ্চাত্যের কারণেই বাংলাদেশের গার্মেন্টসে শ্রমিক ছাঁটাই : দ্য গার্ডিয়ান

করোনা মহামারি কমতে থাকায় ইংল্যান্ড ও উত্তর আয়ারল্যান্ড জুড়ে আবারও খুলতে শুরু করেছে ফ্যাশন হাউজ আউটলেটগুলো। তবে যাদের সস্তা শ্রমে ওই পোশাকগুলো তৈরি, গণহারে তারা চাকরি হারাচ্ছে। মুখোমুখি হচ্ছে খাদ্যাভাবের। বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স এক্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) বলছে, কয়েক বিলিয়ন ডলারের অর্ডার বাতিল হওয়ায় শ্রমিক ছাঁটাই করতে বাধ্য হচ্ছেন গার্মেন্টস মালিকেরা।

এই বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেদন করেছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শ্রমিক অধিকারের সুরক্ষায় কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে পাশ্চাত্যের ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর এই ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে।

মার্চে করোনা মহামারির ব্যাপক প্রাদুর্ভাবের সময় বিভিন্ন দেশে লকডাউন করা হয়। ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো বিশ্বব্যাপী তাদের সরবরাহকারীদের কয়েক মিলিয়ন ডলারের পোশাকের অর্ডার বাতিল করে দেয়। এই বাতিলের তালিকায় ইতোমধ্যেই প্যাকেটজাত হয়ে শিপিং-এর জন্য অপেক্ষমাণ পোশাকও রয়েছে। গার্ডিয়ান বলছে, বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স এক্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ)-এ জানিয়েছে, ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো সরবরাহকারীদের কাছে ইতোমধ্যেই তাদের দেয়া প্রায় তিন বিলিয়ন ডলারের অর্ডার প্রত্যাহার করেছে।

বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক তাদের জানিয়েছেন, গত মাসে ২৫ হাজারেরও বেশি শ্রমিক চাকরি হারিয়েছে। তার আশঙ্কা, বিদেশিদের অর্ডার না পেলে আগামী ছয় মাসে বেকার শ্রমিকের সংখ্যা পাঁচ লাখে পৌঁছাতে পারে।

একটি কেস স্টাডিতে গার্ডিয়ান দেখিয়েছে, রাজধানী ঢাকার ২৬ বছরের একজন পোশাক শ্রমিক নাজমিন নাহার। ধার করা চালের ওপর ভরসা করেই জীবনধারণ করতে হয় দুই সন্তানের মা নাজমিনকে। দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে খাবার বা ভাড়া দেয়ার মতো মজুরি তার হাতে নেই। দীর্ঘ কর্মঘণ্টা সত্ত্বেও ম্যাগপাই নিটওয়্যারের সঙ্গে কাজ করে খুশি ছিল নাজমিন। সেখান থেকে তিনি মাসে ১৫০ পাউন্ড (১৫ হাজার ৭২৮ টাকা) উপার্জন করতেন। এই ম্যাগপাই নিটওয়্যার বার্টন এবং এইচএন্ডএম-এর মতো ব্রিটিশ ব্র্যান্ডগুলোর জন্য পোশাক তৈরি করে। মার্চের শেষদিকে লকডাউনের কারণে কারখানাটি বন্ধ হয়ে যায়। গত ৪ এপ্রিল প্রতিষ্ঠানটি ফের চালু হলেও নাজমিনকে না করে দেয়া হয়।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানকে নাজমিন বলেন, ‘তারা আমাদের বলেছে, বিদেশি ক্রেতারা সব অর্ডার বাতিল করে দিচ্ছে। ফলে কোনও নতুন কাজ নেই। দুই মাস ধরে আমাদের কোনও বেতন নেই। আমাদের বাসা ভাড়া বকেয়া পড়ে আছে। যাবতীয় মুদি সামগ্রী আমরা বাকিতে কিনে থাকি। এখন আগের টাকা পরিশোধ না করা পর্যন্ত তারা আমাদের আর কোনও খাবার দেবে না। বাড়িওয়ালা আমাদের জন্য এক বস্তা চালের ব্যবস্থা করতে পেরেছেন এবং তাতেই আমরা বেঁচে আছি।’

ম্যাগপাই নিটওয়্যারের অর্ডারকারী এইচঅ্যান্ডএম-এর দাবি, তারা ওই গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানের কোনও অর্ডার বাতিল করেনি। প্রতিষ্ঠানটির এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘আমাদের কাছে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ক্ষতিগ্রস্ত সব শ্রমিককে আইন অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে।’

মাতালানসহ অন্যান্য পশ্চিমা ব্র্যান্ডের জন্য পোশাক সামগ্রী তৈরি করে আল্টিমেট ফ্যাশন লিমিটেড। ঢাকা থেকে এক ঘণ্টা দূরের এ প্রতিষ্ঠানটির কারখানায় কাজ করতেন রোজিনা বেগম। তিনি জানান, করোনাভাইরাসের ধাক্কায় কারখানার আরও ৩০০ জন কর্মীসহ তিনি চাকরিচ্যুত হন। সেখানে তার মাসিক বেতন ছিল আট হাজার টাকা।

ট্রেড ইউনিয়ন রোজিনাকে জানিয়েছে, প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ তাদের বলেছে, বিদেশি ক্রেতাদের কাছ থেকে অর্ডার বাতিলের ফলে তাদের এই ছাঁটাইয়ে যেতে হয়েছে।

বাংলাদেশে যদিও কারখানাগুলো এখন ফের চালু হচ্ছে, তবে অর্ডারের পরিমাণ আগের চেয়ে প্রায় ৮০ ভাগ কম। ওয়ার্কার্স রাইটস কনসোর্টিয়াম কর্তৃক চালু করা একটি অনলাইন ট্র্যাকারের তথ্য অনুযায়ী, আর্কাডিয়া, প্রাইমার্ক, এডিনবার্গ উলেন মিলসহ ব্রিটিশ খুচরা ব্র্যান্ডগুলো তাদের সব অর্ডারের জন্য বিদেশি সরবরাহকারীদের পুরো অর্থ পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দেয়নি।

আল্টিমেট ফ্যাশন-এর একজন মুখপাত্র বলেন, ‘কোভিড এবং সামাজিক দূরত্বের কারণে আমাদের ৭০ ভাগ শ্রমিক ও সক্ষমতা নিয়ে উৎপাদন পরিকল্পনা করতে হয়েছিল। এজন্য সরকারি নিয়ম ও বিধান মেনে আমাদের কিছু শ্রমিককে ছাড়তে হয়েছিল।’

আর্কাডিয়া, ম্যাগপাই নিটওয়্যার এবং স্টার্লিং স্টাইলস-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের পক্ষ থেকে অবশ্য এ ব্যাপারে কোনও মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

ক্যাম্পেইনাররা বলছেন, এখন যেহেতু দোকানগুলো ফের চালু হয়েছে, ব্র্যান্ডগুলোরও জন্য তাই তাদের সরবরাহকারীদের প্রতি আর্থিক দায়বদ্ধতার বিষয়টির প্রতি সম্মান জানানো গুরুত্বপূর্ণ।

ক্লিন ক্লথস ক্যাম্পেইনের ক্যাম্পেইনার মেগ লুইস বলেন, ‘আমরা সবাই গত সপ্তাহে ফ্যাশন স্টোরগুলোর বাইরে সারিবদ্ধ মানুষের ছবি দেখেছি। কিন্তু এই একই প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কর্মীদের সবচেয়ে প্রয়োজনের সময়টিতেই তাদের পরিত্যাগ করেছে।’

তিনি বলেন, ‘মহামারিতে নিজেদের আচরণের জন্য ব্র্যান্ডগুলোকে জবাবদিহিতা করতে হয়নি। একটি কারখানাকে দেওয়া অর্ডারের জন্য অর্থ পরিশোধ করা কোনও দাতব্য কাজ নয়। লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকার বিনিময়ে তারা নিজেদের মুনাফার সুরক্ষা নিশ্চিত করেছে।’

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অ্যাপারেল জায়ান্ট গ্যাপ-এর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, ‘আমরা আমাদের বিক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। কয়েক সপ্তাহ ধরে আমাদের অর্ডারগুলো মূল্যায়নের জন্য তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে আলাদাভাবে বৈঠক করেছি। সামনের মাসগুলোর জন্য পরিকল্পনা করেছি।’

আরেক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান মাতালান-এর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘আমরা সেই পণ্যগুলো বিক্রি করতে না পারলেও, ইতোমধ্যেই ট্রানজিটে থাকা অর্ডারগুলোর প্রতি সম্মান জানাচ্ছি। অর্ডার বাতিল এড়াতে যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছি।’

Originally posted 2020-06-21 19:28:28.



Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked as *