বাংলাদেশের ৪ কোটি শ্রমিক ঈদ করবে বেতন-বোনাস ছাড়াই

চাঁদ দেখা সাপেক্ষে এবার ২৯ রোজা হলে পবিত্র ঈদুল ফিতরের বাকি আছে তিন দিন। সংশ্লিষ্ট সব সূত্রের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, দেশের প্রায় চার কোটি শ্রমিক আসন্ন এ ঈদে শূন্য হাতে বাড়ি ফিরবেন; তাদের কপালে বেতন-বোনাস কিছুই জুটবে না। এসব শ্রমিক যেসব কারখানায় কর্মরত, সেগুলোর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি প্রতিষ্ঠানে এখনো পর্যন্ত এপ্রিল মাসের বেতনই হয়নি; ঈদ বোনাসের তো প্রশ্নই আসে না। দেশে পোশাক কারখানা খাত ছাড়া অন্যান্য খাতের শ্রমিকদের অধিকাংশই চুক্তিভিত্তিক হয়ে থাকেন। আর চুক্তিভিত্তিক হওয়ায় কাজ না থাকলে তাদের বেতনও জুটে না। আর বেতন না পেলে বোনাসের প্রসঙ্গও আসে না। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে ৪২টি খাতে প্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিক রয়েছে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ। অপ্রাতিষ্ঠানিক মিলে এ সংখ্যাটি প্রায় সাড়ে ছয় কোটি। তৈরি পোশাকশিল্প রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত হওয়ায় এ খাতে সার্বিক নজরদারিও বেশি। তাই এ খাতের শ্রমিকরা অন্য খাতের শ্রমিকদের চেয়ে কম বঞ্চিত হন। অথচ এ খাতের শ্রমিকরাই এখনো সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ করে তাদের বেতন-বোনাস ওভারটাইম বকেয়া পাওনা আদায়ের আন্দোলন করছেন। অন্য খাতের শ্রমিকদের পরিস্থিতি আরও নাজুক। খবর আমাদের সময়ের।

হিসাব বলছে, পোশাক খাতে সংশ্লিষ্ট শ্রমিক প্রায় ৪২ লাখ। বাকিরা অন্যান্য খাতে। প্রতিদিন শ্রমিকদের আন্দোলন করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিলেও তারা পেটের দায়ে পথ ছাড়তে পারছেন না। জানা গেছে, এখনো অর্ধেকের বেশি পোশাকশ্রমিক এপ্রিল মাসের বেতন পাননি। বেতন-বোনাসের দাবিতে প্রায় প্রতিদিনই গাজীপুর, আশুলিয়া, সাভারের তৈরি পোশাকের কারখানা অধ্যুষিত এলাকায় শ্রমিক বিক্ষোভ হচ্ছে। সরকার ঘোষিত ৫ হাজার কোটি টাকা তহবিল থেকে ঋণ পেলেও খোদ বিজিএমইএ ও বিকেএমইএভুক্ত অর্ধেকের বেশি কারখানা বেতন দেয়নি। এ পরিস্থিতির জন্য ব্যাংকের ওপর দোষ চাপাচ্ছেন গার্মেন্টস মালিকরা।

শিল্প পুলিশের তথ্য মতে, গত সোমবার পর্যন্ত সারাদেশের ৭ হাজার ৬০২টি পোশাক কারখানার মধ্যে এপ্রিলের বেতন পরিশোধ করেছে ৩ হাজার ১৭৫টি, যা অর্ধেকেরও কম। বেতন পরিশোধের ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে রপ্তানি প্রক্রিয়া অঞ্চলের (বেপজা) ভেতরে অবস্থিত কারখানা। আর পিছিয়ে আছে বিকেএমইএর সদস্যভুক্ত কারখানা।

জানা গেছে, গতকাল বকেয়া বেতন, ফেব্রুয়ারি মার্চ মাসের ওভারটাইম ও ঈদ বোনাসের দাবিতে রাজধানীর মিরপুরের এমবিএম গার্মেন্টস লিমিটেড, লড স্টার ফ্যাশন লিমিটেড, ড্রিমক্স ওয়্যার লিমিটেড, সারোজ গার্মেন্টস লিমিটেড, রিসাল গার্মেন্টস লিমিটেড, জকি গার্মেন্টস লিমিটেড, ভিশন গার্মেন্টস প্রাইভেট লিমিটেড, ফর ইউ ক্লোথিং লিমিটেড, ফ্যাশন ২০০০ লিমিটেড, ডায়ানা গার্মেন্টস প্রাইভেট লিমিটেড, সেনটেক্স টেক্সটাইলস (প্রা.) লিমিটেড, সেনটেক্স অ্যাপারেলস লিমিটেড, হামিম অ্যাপারেলস লিমিটেড, চিটাগাং ফ্যাশন লিমিটেড ও পাওয়ার ভ্যান্টেজ ওয়্যার লিমিটেড কারখানার শ্রমিকরা বিক্ষোভ ও ভাঙচুর করেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যমতে, বিজিএমইএর সদস্যভুক্ত ১ হাজার ৮৮২টি কারখানার মধ্যে বেতন পরিশোধ হয়েছে ৯৯১টি কারখানা। বিকেএমইএর সদস্যভুক্ত কারখানাগুলোর অবস্থা আরও নাজুক। মোট ১ হাজার ১০১টির মধ্যে বেতন হয়েছে ৩৮৮টিতে। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সদস্যভুক্ত ৩৮৯টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বেতন হয়েছে ১৯৮টিতে। রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (বেপজা) ভেতরে অবস্থিত বেশিরভাগ কারখানা বেতন পরিশোধ করেনি। অন্যান্য ৩৮৬৬টির মধ্যে ২ হাজার ৫৭২টি কারখানা বেতন দেয়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, ৫ হাজার কোটি টাকার তহবিল থেকে ঋণ নিতে ২ হাজার ২০০টি কারখানার মালিক আবেদন করেছেন। এর মধ্যে বিজিএমইএ সদস্যভুক্ত কারখানার সংখ্যা ১ হাজার ৬১৫টি; বিকেএমইএভুক্ত ৫৫০টি। বাকি ৩৫টি ইপিজেড এলাকায় অবস্থিত পোশাক কারখানা। বাংলাদেশ ব্যাংকে ৪৬টি ব্যাংকের মাধ্যমে এসব কারখানার মালিকদের ৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকার ঋণ আবেদন জমা পড়েছে। আবেদনের বিপরীতে ইতোমধ্যেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর হিসাবে ২ হাজার কোটি টাকা বিতরণ করা হযেছে।

যদিও শিল্প পুলিশের তথ্য সঠিক নয় দাবি করে বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক বলেন, সোমবার পর্যন্ত সদস্যভুক্ত এক হাজার ৫০৯টি কারখানায় এপ্রিলের বেতন দেওয়া হয়েছে। আর ৩৩টি কারখানা বোনাস দিয়েছে। বিজিএমইএর সব কারখানা ঈদের আগে বেতন-বোনাস পরিশোধ করবে বলে জানান তিনি।

বিকেএমইএর প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, এপ্রিলের বেতন সরকারের বেঁধে দেওয়া নিয়ম অনুযায়ী হবে। এখানে মালিকদের কিছুই করার নেই। নিয়ম অনুযায়ী শ্রমিকদের বেতনের সব কাগজপত্র ব্যাংকে জমা দেওয়া হয়েছে। এখন ব্যাংক টাকা শ্রমিকদের মোবাইল অ্যাকাউন্টে পাঠাবে। এতে ব্যাংক ব্যর্থ হলে দায়দায়িত্ব মালিকরা নিতে পারবেন না। কারণ আমরা আগেই বলেছি, এ সিস্টেম বেতন দিতে গেলে জটিলতা দেখা দেবে। তিনি আরও বলেন, অনেক কারখানার আবেদন ব্যাংকগুলো প্রসেসই করেনি। সে ক্ষেত্রে ওইসব কারখানার বেতন দিতে ব্যর্থ হবে। এর দায় মালিকদের দেওয়া যাবে না। শিল্প এলাকায় শুক্র ও শনিবার ব্যাংক খোলা রাখার দাবি জানান তিনি।

জানতে চাইলে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব কেএম আলী আজম বলেন, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সব সময় শ্রমিকের অধিকার আদায় কাজ করে। বেতন-বোনাসের বিষয়ে মালিকদের সঙ্গে মন্ত্রণালয়ে কয়েকদফা বৈঠক করেছে। বৈঠক থেকে একটি সিদ্ধান্ত হয়েছে, যা মালিক ও শ্রমিকপক্ষ উভয় মেনে নিয়েছে। ঈদের আগেই সব শ্রমিককে এপ্রিল মাসের বেতন বকেয়া পাওনা পরিশোধ করার কথা। পাশাপাশি ঈদের আগে বোনাস পরিশোধ করার কথা রয়েছে। এর পরও শ্রমিকদের রাস্তা অবরোধ করা, ভাঙচুর করা অপ্রত্যাশিত।

তিনি বলেন, মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রতিনিয়ত খানাগুলো পরিদর্শন করা হয়। কোথাও কোনো অসঙ্গতি পেলে সে অনুযায়ী রিপোর্ট করা হয়। মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও বিধান রয়েছে।

আমরা শিল্পকারখানা মালিকদের বারবার অনুরোধ করছি, যাতে তারা শ্রমিকদের পাওনা দিয়ে দেন।

এদিকে গত শনিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সভাপতিত্বে সরকার-মালিক-শ্রমিক পক্ষের ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের পদস্থ কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিজেএমইএ-বিকেএমইএ ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিরা। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, এবার তৈরি পোশাক শ্রমিকদের ৫০ ভাগ ঈদ বোনাস দেওয়া হবে। বাকি ৫০ ভাগ পরবর্তী ৬ মাসের মধ্যে সুবিধাজনক সময়ে বেতনের সঙ্গে দেওয়া হবে। যেসব মালিক পুরো বোনাস দিতে পারবেন, তারা পুরোটাই দেবেন। আর যারা এক সঙ্গে পুরোটা দিতে না পারবেন, তারা ঈদের আগে গত বছর যে বোনাস দিয়েছে, তার অর্ধেকটা দেবে।

যদিও বোনাস কখন, কীভাবে দেওয়া হবে তার কিছুই জানে না শ্রমিক নেতারা। বোনাসের অর্থ মোবাইলে পাঠানো হবে, নাকি নগদ দেওয়া হবে সে বিষয়ে পুরোপুরি অন্ধকারে আছেন তারা। এদিকে বোনাসের দাবিতে রাজধানীর কয়েকটি স্থানে কারখানা ভাঙচুর চালায় বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা।

জাতীয় গার্মেন্ট শ্রমিক কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, সরকার গতবারের ৫০ শতাংশ বোনাস ঈদের আগে দেওয়ার কথা বললেও অনেক কারখানা তা মানছে না। মাঝারি আকারের ও সাব-কন্ট্রাকে কাজ করা বেশিরভাগ কারখানা সরকারি শ্রমিকদের জানিয়ে দিয়েছে, তারা বোনাস দিতে পারবে না। বোনাস না দেওয়ায় মিরপুরে কারখানা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।

সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার বলেন, এ সমস্যার সমাধান একমাত্র মালিক শ্রমিকরাই করতে পারেন। শ্রমিকদের সঙ্গে বসে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে পারেন।

তিনি বলেন, বড় কারখানাগুলো শতভাগ বোনাস দিলেও সমস্যা নেই। কারণ তাদের বেতনের টাকা সরকার দিয়েছে। আর যেসব ছোট কারখানা রয়েছে সেগুলোর শ্রমিকরা যাতে বেতন-বোনাস পেতে পারে সে ব্যাপারে বিজিএমইএ মালিকপক্ষ মিলে সমাধান করতে পারে। এ বিষয়গুলো আগে সিদ্ধান্ত নিলে শ্রমিকরা রাস্তায় নামত না। এখন শ্রমিকরা রাস্তায় নামার ফলে করোনা ভাইরাস ব্যাপকভাবে সংক্রমণের আশঙ্কা রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, মালিকদের সমস্যার কথা বিবেচনায় নিয়ে সরকারি সিদ্ধান্ত দিয়েছে। এখন তারা কেন ছলচাতুরি করছে এটিই বুঝে আসছে না।

জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, মালিক-শ্রমিক ভুল বোঝাবুঝির কারণে এখন শ্রমিকরা রাস্তায়। শ্রমিকদের ভালোভাবে ডেকে বুঝিয়ে কথা বললে হয়তো তারা রাস্তায় নামত না। বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে শ্রমিকরাও অবহিত। কিন্তু তাদের ভালোভাবে বুঝিয়ে বলা হচ্ছে না।

তিনি বলেন, যেসব কারখানা বেতন-বোনাস দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে তারাও এখন এদিক-সেদিক করছে।

তিনি বলেন, বিজিএমইএ-বিকেএমইএ সদস্য ছাড়াও অনেক সাব-কন্ট্রাক্ট কাজ করা কারখানার শ্রমিকরাও এখন রাস্তায় নেমেছে। এসব কারখানার মালিকরা সরকারের দেওয়া পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা পাবে না। এসব মালিকরাও এখন হাত গুটিয়ে নিয়েছেন। ফলে শ্রমিক অসন্তোষ আরও বেড়েছে।

গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার বলেন, বোনাস তো দূরের কথা। যে ধীরগতিতে এপ্রিলের বেতন দেওয়া হচ্ছে, তাতে ঈদের দিনও সব কারখানার শ্রমিকরা বেতন পাবে না কিনা সন্দেহ আছে। মালিকপক্ষের গাফিলতির কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অবস্থা ভয়ঙ্কর জায়গায় চলে যাচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, সরকার শ্রমিকদের বেতন দেওয়ার জন্য ৫ হাজার কোটি টাকা তহবিল ঘোষণা করেছে। কিন্তু সেটি শ্রমিকদের পকেট পর্যন্ত যাচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করতে যতটা উদ্যোগ নেওয়া দরকার ছিল, তা করা হয়নি। ফলে মালিকরা স্বেচ্ছাচারীর ভূমিকায় অবর্তীন হয়েছেন।

তিনি বলেন, শ্রমিকরা তাদের পাওনা আদায়ের দাবিতে রাস্তায় নেমেছেন। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে পারছেন না। ফলে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে।

মিরপুরে অবস্থিত ডায়না গার্মেন্টস প্রাইভেট লিমিটেডে কর্মরত সুইং অপারেটর সাহিদা আক্তার বলেন, দুই মাসের ওভারটাইম বকেয়া রয়েছে। বারবার সময় দিও পরিশোধ করছে না। এ ছাড়া এপ্রিল মাসের বেতন পরিশোধ করেনি। ঈদের বোনাস দেওয়ার বিষয়ে কোনো আলোচনাই নেই। অবস্থার মধ্যে আমাদের জীবন কীভাবে বাঁচবে? মালিকপক্ষ দিনের পর দিন ঘুরাচ্ছে। কথা বললেই ছাঁটাই করছে। মিরপুরের আরেক গার্মেন্টস শ্রমিক শিউলি আক্তার বলেন, সর্বনিম্ন ৫০% বোনাস দেওয়ার কথা থাকলেও মালিকরা দিচ্ছেন না। গত দুই মাসে বেতন বকেয়া রয়েছে, তাও পরিশোধ করছে না। অবস্থা বেঁচে থাকাই দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

Originally posted 2020-05-20 10:50:40.



Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked as *