বিষাদের প্রণয় | খাঁন নাজমুস সাহাদাত

গ্রামের অসহায়দের মধ্যে লালুর বাবা জামাল বেপারি ছিলো প্রথম সারির দিকে। হতদরিদ্র চাষাবাদের জমিজমাহীন শ্রমজীবী একজন মানুষ। অন্যের ক্ষেতে কাজ করলে হয়তো দুই বেলা অন্ন জোটে। লালুর বয়স সবে মাত্র ৫ বছর।লালুর বাবা তাকে স্কুলে ভর্তি করেছে।লালু স্কুলে যায় নিয়মিত। জামাল বেপারির পক্ষে সংসার চালানো খুব কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। দিনের পর দিন জামাল বেপারি অক্লান্ত পরিশ্রম করে কিছু টাকা জমিয়েছে, লালুর মা জমিলা বেগম এ খবর রাখে না।

একদিন সকালে জামাল বেপারি গোসল করে এসে উঠানে দাঁড়িয়েছে মাত্র, জামিলা দেখে তো অবাক! কি গো তুমি এতো সকালে গোসল করেছো, সাহেব হয়েছো নাকি?
জামাল উত্তর দিল হ্যাঁ রে জামিলা।সেদিন সকালে পান্তা খেয়ে লালুর বাবা কোথায় যেন চলে গেল।লালু যথা সময়ে স্কুলে গেল।এদিকে জামিলা তো ভেবে অস্থির কি হলো? আমাদের লালুর বাপ আমকে কিছু না বলে তো কোথাও যায় না!তাহলে কি এমন হলো! আমার কিছু না জানিয়ে কোথায় গেছে? নানান প্রশ্ন লালুর মায়ের মনে।

এদিকে জামাল বেপারি বাসায় ফিরতে অনেক দেরি করে ফেলেছে, সকালে বের হয়েছিলো কিন্তু সকাল গড়িয়ে দুপুর এবং দুপুর গড়িয়ে বিকাল হলো তারপরও লালুর বাবার কোন খোজ নাই।লালু বার বার মাকে প্রশ্ন করতে লাগলো মা বাবা কই? লালুর মা কোন উত্তর দিতে পারে না।লালুর মায়ের মনে অস্থিরতা বিরাজ করছে।বাড়ির কাজ গুছিয়ে লালুর মা লালুকে সঙ্গে করে মেঠো পথ বেয়ে গ্রামের বড় রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়েছে, অমনি দূরে তাকিয়ে দেখে জামাল বেপারির মত একটা লোক হেটে আসছে রশি হাতে লাল রঙের গরু নিয়ে।লালুর মায়ের মনে প্রশ্ন জাগে গরু পাবে কোথা থেকে? জামালের কাছে তো কোন টাকা নাই!

এতক্ষনে লালুর বাবা কাছে চলে এসেছে। লালু ছুটে গেলো বাবার কাছে, লালু বাবাকে জিজ্ঞেস করে,
লালু: বাবা! গরু কোথা থেকে পেলে?
জামাল: হাঁট থেকে কিনে এনেছি।
লালু:সত্যি বলছো বাবা?
জামাল: হ রে বাবা তোকে মিথ্যা বলতে পারি?
এদিকে জামিলার বাবা ছেলের কথা শুনে চোখে পানি চলে আসে।জামিলা একটু অভিমান করে বলে,
জামিলা: আমাকে কিছু বললে না তো?
জামাল: তোমাকে চমকে দেওয়ার জন্য বলিনি।
জামিলা: কত নিছে গরু?
জামাল: ১৫ হাজার টাকা।
জামিলা: ভালো করেছো।

গরু কেনার সাথে সাথে জামাল সেদিন বাজার থেকে একটা বড় মাছ কিনে নিয়ে আসে।রাতে লালুরা তৃপ্তিসহকারে ভাত খায়।রাতে ঘুমানোর আগে লালু আর লালুর বাবা, মা গরুটা দেখে ঘুমাতে যায়।শুয়ে লালু ও তার বাবা মা গরুটা নিয়ে অনেক গল্প করে লালু শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যায়।জামিলএবং জামালের আর ঘুম আসেনা, জামাল গরুটা গাভী কেনায় জামিলা বেজায় খুশি। জামাল আর জামিলা গরুটা নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। গরুর বাছুর হবে তা বিক্রি করে একটা বাড়ি বানাবে,পারলে মাঠে অল্প হলেও জমি কিনবে।আরো কত কি!

এভাবে কেটে গেলো আরো ৮ মাস।লালুদের সেই গরুর বাচ্চা হয়েছে আজ।লালু স্কুল থেকে ফিরে কি যে খুশি! লালু সারাদিন গরুর বাছুর নিয়েই আছে।সন্ধ্যায় লালু তার মাকে বলে, মা গরুর বাচ্চাটা মেয়ে নাকি ছেলে? লালুর মা মুচকি হেঁসে বলল মেয়ে বাচ্চা।লালু সারারাত ঘুমাতে পারে না বাচ্চা গরুটার একটা নাম রাখা চাই।এই চিন্তায় কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে কে জানে। পরেরদিন ফজরের নামাজ শেষে জামাল একটা কাশি দিতেই লালুর ঘুম ভেঙে গেলো।লালু ঘুম থেকে উঠেই বাচ্চা গরুর কাছে গেলো।দেখলো গরুটা ঘুমিয়ে আছে।লালু পাশে বসে আছে,গরুটার ঘুম ভাঙানো যাবে না।তাহলে সে কষ্ট পাবে।কিছুক্ষণ বসার পরে বাচ্চা গরুটার হাই তুলে ঘুম ভাঙে।লালুও উঠে দাঁড়ায়, বাচ্ছা গরুটা দুধ খেতে মায়ের কাছে যায়,পিছে পিছে লালুও যায়।বাচ্চা গরুটার সাথে লালুকে দেখে মা গরুটা লালুকে তাড়া করে,লালু এক দৌড়ে লালুরে মায়ের কাছে ছুটে আসে।

লালু তার মাকে বলে ও মা,বাচ্চা গরুটার একটা নাম রেখে দাও।লালুর মা লালুর নামের সাথে নাম মিলিয়ে বাচ্চা গরুটার নাম দেয় লাইলী।লালু আর লাইলী নামটা খুব পছন্দ হয় লালুর।লালু আবার ছুটে আসে লাইলীর কাছে।লালু লাইলীকে ডাকে কিন্তু লাইলী তো বুঝে না।লাইলী লালুর ডাকে সাড়া না দেওয়াতে লালু সেদিন কান্না করতে করতে স্কুলে যায়।লালু স্কুলে গিয়েও পড়ায় মন বসাতে পারে না।সারাক্ষণ লাইলীর চিন্তায় বিভোর লালু।লালু বাড়িতে যতটুকু সময় পায় ততটুকু সময় লাইলীর সাথে খেলা করে সময় কাটে। অল্প কিছু দিনের মধ্যে লালুর সাথে লাইলীর সখ্যতা গড়ে উঠে।লালুকে দেখলে লাইলী দৌড়ে কাছে চলেআসে।লালুর খুব ভালো লাগে।চিন্তা চেতনায় লাইলী ছাড়া লালুর আর কিছু নাই।

এদিকে লালুদের গ্রামের মাতবর জলিল মিঞার চোখ লালুর গরুর উপরে পড়ে।লালুর বাবাকে ডেকে জলিল মিঞা বলে, তোমার গাভীর কি খবর?লালুর বাবা বলে ভালো,দিনে ৮ কেজি দুধ পাচ্ছি।জলিল মিঞা বলে দেখো,তোমার গাভীটা আমাকে দিয়ে দাও,বিনিময়ে কিছুদিন আমার একটা জমি আবাদ করে খেও।মাতবরের কথা শুনে লালুর বাবার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে।কত স্বপ্ন লাইলী আর লাইলীর মাকে নিয়ে।লালুর বাবা বিষন্ন মন নিয়ে বড়িতে আসে, দেখে জামিলা প্রশ্ন করে কি হয়েছে তোমার?লালুর বাবা মাতবরের কথা খুলে বলে।জামিলা আগে থেকেই জানতো মাতবর কারো ভালো দেখতে পারে না।জামিলা মনে মনে ভাবে জামাল আমাকে বিয়ে করে বাড়িতে নিয়ে আসার পর মাতবরের কু নজর থেকে আমিও রক্ষা পাইনি।এখন আমার সংসার ভালো চলছে মাতবরের সহ্য হচ্ছে না।জামিলা আরো ভাবে! পৃথিবীর সব মাতবররা কি এমন?

লালু তার বাবা মার কথা মন দিয়ে শুনে।লাইলীকে ডেকে লালু ঘরের পিছনে সুপারি বাগানে নিয়ে যায়।লাইলির গলা জড়িয়ে আদর করে আর বলে লাইলী তুই মাতবর এর বাড়ি যাবি না তো? আমি তোকে ছাড়া থাকতে পারবো না।লালু কান্না করছে,কেন জানি সেদিন লাইলীর চোখ দিয়ে পানি পড়েছিলো।হয়তো লালুর পবিত্র ভালোবাসা অবলা পাশু বুঝতে পেরেছিলো।এদিকে লালুর বাবা মা মাতবর কে বলে দেয় তারা গরু দেবে না তাদের জমির দরকার নাই।

তার কিছু দিন পরে লালুর বাবা লাইলীর মাকে ঘাস খাওয়ানোর জন্যে মাঠে বেঁধে আসে।ওই মাঠে মাতবর শস্য ক্ষেত দেখতে বের হয়েছিলো। মাঠের মধ্যে লালুদের গরু দেখে মাতবর তার শাগরেদকে বলে যা গরুর রশি ছিড়ে দে।মাতবর এর অবাধ্য হওয়ার পরিণতি কি জামাল বুঝলো না।এদিকে দুপুরে জামাল গরু নিতে এসে দেখে গরু রশি ছিঁড়েছে।জামাল অনেক খুঁজেও গরু পায়নি।বাড়িতে ফিরে গরু না পাওয়ার কথা বলতেই জামিলার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। কিছুতে জামিলা ভাবতে পারছে না।লালু এ খবর শোনা মাত্র কান্নায় ভেঙে পড়েছে।জামিলা ভাবে আমাদের একমাত্র সম্পদ বলতে গরু দুটি ছাড়া আর কিছু নাই।তাতেও কেন বিধাতা নারাজ!

দুপুরে খাওয়ার কথা লালুদের মাথায় নাই।কোথায় গেলে গরু পাবে সেটা এখন মূখ্য বিষয়। লালুর কান্না করতে করতে শরীররে জ্বর চলে আসে।লালুর বাবা মা অনেক চেষ্টা করেও গরু খুজে পাইনি।এদিকে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়েছে, সবাই ক্লান্ত জামাল আর জামিলা দুটো ভাত মুখে দেবে ঠিক তখনি লালুর প্রচণ্ড বমি আসছে।বমি করতে করতে লালু অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে।অচেতন অবস্থায় লালুর মুখে একটাই নাম লাইলী, লাইলী,লাইলী!ছেলের অবস্থা দেখে জামাল,জামিলা কান্না থামাতে পারে না।যখন রাত ৮ টা বাজে তখন লালুর জ্ঞান ফিরলো।লালুর মা লালুকে বলে বাবা তুই দুটো ভাত খা, আমরা লাইলিকে খুঁজতে যাবো।এই কথা শুনে লালু ভাত খেতে রাজি হয়।লালুর খাওয়া শেষে।তারা গরুর খোঁজে বের হয়।

হাতে একটা হারিকেন নিয়ে লালু, লালুর বাবা,মা মাঠের মধ্যে হাঁটতে থাকে আর লালু শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ডাকতে থাকে, লাইলী! লাইলী!! লাইলী….!!! এদিকে এই শব্দ বাতাসে ভেসে মাতবর এর কানে পৌছে।তখন মাতবর হাসে আর বলে আমার মতের বাইরে চললে তার পরিণত এমন হয়।লালুরা গরু খুঁজতে খুঁজতে অনেক দূরে একটা বাগানের কাছে চলে যায়।লালু লাইলী, লাইলী ডাকতে থাকে।লালুর লাইলী ডাক শুনে হঠাৎ বাগানের মধ্য থেকে লাইলীর কণ্ঠ শোনা যায় হাম্বা, হাম্বা।লাইলীর ডাক শোনা মাত্র তাদের চোখে মুখে পৃথিবীর সবচেয়ে দামী রত্ন খুঁজে পাওয়ার আনন্দ।বাগানে পৌছে দেখে লাইলীর মা গাছের সাথে রশি পেচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।লালুরা সেদিন রাতে গরু নিয়ে বাসায় ফেরে, লালুর জ্বর,বমি সব ভালো হয়ে যায়।

এর কিছু দিন পরে লালুর বাবা ঘরের ছাউনি মেরামতের কথা চিন্তা করে, লাইলীকে বিক্রি করা সিদ্ধান্ত করে।এ কথা লালু জেনে যায়।লালু ভাবতে থাকে আমার জীবন দিয়ে হলেও লাইলীকে বিক্রি করতে দেবো না।তার লাইলীর প্রতি ভালোবাসা দিনে দিনে বেড়ে চলেছেই।লাইলীও লালুর কথা শুনে তাদের মধ্যে এক অন্যরকম ভালোবাসা। কেন জানি লাইলী লালুকে বুঝে ফেলেছে।এর মধ্যে মাতবর কোন ভাবেই মেনে নিতে পারে না জামাল,জামিলা দুটো গরুর মালিক ।গরু দুটো যেন তার চাই চাই!জামাল আর জামিলা ঠিক করেছে আগামি রবিবার লাইলীকে হাঁটে নিয়ে যাবে বিক্রির জন্য একথা লালুকে বলবে না।শনিবারের দিন লালুর মনে শান্তি নাই।কেনো জানি লালুর কিছুই ভালো লাগছে না।লালু শনিবার বিকালে লাইলিকে মাঠের মধ্যে নিয়ে অনেক আদর করল।লাইলিকে বললো লাইলি আমার কেমন জানি হচ্ছে,লাইলি আমি মনে হয় আর বাঁচবো না আমার খুব কষ্ট হচ্ছেরে লাইলি।কেনো জানি মনে হচ্ছে আমি তোর সাথে থাকতে পরবো না।আমার দম বন্ধ হয়ে আসছেরে লাইলি।সেদিনো লাইলির চোখ দিয়ে পানি ঝরেছিলো।এই পানি ঝরাটা ছিলো অনেক বেশি।লালু রাতে লাইলিকে যখন গোয়াল ঘরে ঘুমানোর আগে দেখতে গিয়েছিলো তখনো লাইলির চোখ দিয়ে পানি ঝরছে।লালু লাইলির গলায় হাত বুলিয়ে আদর করে আর বলে লাইলি তুই কাঁদিস না,তুই কাঁদলে আমি সহ্য করতে পারি না।

রবিবার সকাল হলো জামিলা লালুকে সেদিন খুব সকালে স্কুলে পাঠানোর জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগলো।এ দিকে লালুর বাবা গোয়াল থেকে চিৎকার করতে লাগলো। ওরে লালু, ওরে জামিলা গোয়ালে গরু নাই।গরু কই গেলো? সেদিন অনেক খুঁজেও লাইলী আর লাইলীর মাকে পাওয়া যায়নি।গরু যে কোথায় হারালো তা অজানা রয়ে গেল।হয়তো সমাজপতিদের লোলুপ দৃষ্টিতে লালুদের গরু থাকাটা অপরাধ!

Originally posted 2020-06-16 06:14:53.



Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked as *