মায়ের সঙ্গে শেষ দেখা হলো না সাংবাদিক মুশতাকের

এ যেনো যুদ্ধক্ষেত্র। জীবন বাঁচাতে বিদেশ পাড়ি দেয়া সাংবাদিক মুশতাকের জীবনে ঘটলো এমনই ঘটনা। মৃত্যুশয্যায় ছেলেকে এক নজর দেখার জন্য মায়ের আকুতি দেখলে মনে হয় কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর লেখা কবিতাটি। যিনি তার কবিতায় এক ভাষা সৈনিকের মায়ে চিঠির জবাবে বলেছিলেন,

মাগো, ওরা বলে,সবার কথা কেড়ে নেবে।তোমার কোলে শুয়ে গল্প শুনতে দেবে না। বলো, মা, তাই কি হয়? তাইতো আমার দেরী হচ্ছে। তোমার জন্য কথার ঝুড়ি নিয়ে তবেই না বাড়ী ফিরবো। লক্ষ্মী মা রাগ ক’রো না, মাত্রতো আর কটা দিন।’…কিন্তু আর কোনোদিন তার বাড়ি ফেরা হয়নি।তার আগেই শত্রুর গুলিতে প্রাণ দিতে হয় তাকে।
ঠিক তেমনি কথার ঝুড়ি নিয়ে মায়ের কাছে আর ফেরা হয়নি মুশতাক আহমেদের তার আগেই চিরতরে স্তব্ধ হয়ে গেছে তার কন্ঠ,বলা যায় স্তব্ধ করে দেয়া হয়েছে।
একজন প্রথিতযশা সাংবাদিক এবং দেশের প্রথম সফল কুমির ব্যবসায়ী ছিলেন মুশতাক আহমেদ। ছিলেন দেশ চিন্তক এবং রাজনীতি সচেতন। প্রতিবাদ মনস্ক ব্যক্তিটি গত বছরের ৫ মে গ্রেপ্তার হন আহমেদ কবির কিশোরের একটি কার্টুন শেয়ার এবং ক্যাপশন লেখার কারনে। হয়তো তিনি কল্পনাও করেননি তার এই ঘটনাটিই জীবনঘাতী হবে। “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন” তথা ৫৭ ধারাতে তার বিরুদ্ধে আনা হয় দেশ বিরোধী ষড়যন্ত্র এবং গুজব ছড়ানোর অভিযোগ।সেই যে গ্রেপ্তার হলেন তারপর একে একে ৬ বার জামিন চেয়েও পাননি তিনি।

দীর্ঘ একবছরের কাছাকাছি সময়ে কারাগারে থেকে শিকার হয়েছেন অমানুষিক নির্যাতনের। যার কিছুটা তথ্য উঠে এসেছে ৫ই মার্চ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশ হওয়া আহমেদ কবির কিশোরের সাক্ষাতকারে।যিনি একই মামলার মুশতাক আহমেদের সাথে কারাবন্দী ছিলেন। তার ভাষ্যমতে মুশতাককে এ পরিমাণ নির্যাতন করা হয় যে তিনি নির্যাতনের তীব্রতা সহ্য করতে না পেরে কাপড়েই মল ত্যাগ করেছেন।কি নৃশংস বর্বরতা!
এছাড়াও সম্প্রতিক সময়ে নোয়াখালীতে,২৫ বছর বয়সী মুজাক্কির দৈনিক বাংলাদেশ সমাচার এবং অনলাইন নিউজ পোর্টাল বার্তা বাজারের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন।
গত ১৯ এ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার বিকালে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষে সংঘর্ষের সময় ভিডিও ধারণ করছিলেন মুজাক্কির। এ সময় সংঘর্ষকারীদের ছোঁড়া গুলি তার গলা, মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে বিদ্ধ হয়। পরে তাকে গুরুতর অবস্থায় প্রথমে নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখান থেকে রাতেই উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।সেখানেই সে মৃত্যুবরণ করেন।
পর্দার বাইরে আাসা এমন শরীর শিউরে উঠা তথ্যের আলোকে ধারনা করা যায়, পর্দার অন্তরালে এ রাষ্ট্রযন্ত্র কতটা ভয়ানকভাবে চড়াও হয় তার অন্যায়কে অন্যায় বলে আখ্যায়িত করা মানুষদের উপর! দীর্ঘ ১৩ বছরের এ সরকারের আমলে ধীরে ধীরে সচেতনভাবে কেড়ে নেয়া হয়েছে বাক স্বাধীনতার অধিকার। বলী হতে হয়েছে অসংখ্য ভিন্নমতপোষণকারী রাজনীতিবিদ কিংবা প্রতিবাদী সাংবাদিকদের। এমনি একটি হত্যাকান্ডের শিকার হওয়া সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার কোন সুরাহাই হয়নি এখন পর্যন্ত।যেখানে ক্ষমতাসীন দলের ভয়ংকর অপরাধীরা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমা পেয়ে বিদেশ পালানোর সুযোগ পায়, যে একই রাষ্ট্রে ন্যূনতম ভিন্নমতের কারণে কার্টুনিস্টকে কারাবন্দী করা হয়।আবার সে কার্টুনের ক্যাপশন লিখার দায়ে কাউকে জীবন দিতে হয়, সে রাষ্ট্র কখনোই একজন সাধারণ নাগরিকের জন্য নিরাপদ স্থান হতে পারেনা, অন্তত এই সভ্য পৃথিবীতে। সে রাষ্ট্র স্পষ্টত খুনি।
সাংবাদিক এর উপর হামলা,মামলা এবং হত্যা এ যেনো নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।অথচ একটি গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হলো সাংবাদিক রা।বর্তমান এই ফ্যাসিস্ট সরকারের অামলে,স্হানীয় থেকে জাতীয় পর্যায়ের সকল সাংবাদিকরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
দেশ থেকে হাজার মাইল দূরে থেকেও আমি শঙ্কিত, আতংকিত একইসাথে ক্ষুদ্ধ। ভাষার স্বাধীনতার জন্য যে জাতি প্রাণ দিয়েছে সে জাতিরই ২ জনকে যখন সে ভাষাতেই মত প্রকাশের কারনে দিনের পর দিন অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করে ভাষার মাসেই জীবন দিতে হয় তখন সত্যিই অসহায়ত্বের প্রকাশ করা ছাড়া আর কিইবা থাকে!!



Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked as *