ইউক্রেনে রাসায়নিক হামলা চালাতে পারে রাশিয়া

ইউক্রেনে রুশ সামরিক অভিযান তৃতীয় সপ্তাহে গড়িয়েছে, কিন্তু এখনো বড় ধরনের কোনো সাফল্য পায়নি রাশিয়া। এ অবস্হায় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আরো বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারেন। তার নির্দেশে ইউক্রেনে রাসায়নিক হামলা চালাতে পারে রুশ বাহিনী এমনই আশঙ্কা করছে যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি পশ্চিমা দেশ। এদিকে মারিউপোলের মাতৃত্বকালীন ও শিশু হাসপাতালে যে বোমা হামলা হয়েছে, তাকে যুদ্ধাপরাধ বলে দাবি করেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি।

ইউক্রেনে বেসামরিক মানুষের প্রাণহানি বাড়তে থাকায় রুশ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া শুরুর দাবিও জোরালো হয়েছে। অন্যদিকে কোনো ধরনের অগ্রগতি ছাড়াই রাশিয়া ও ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক তুরস্কে শেষ হয়েছে।

গতকাল রুশ আগ্রাসনের ১৫তম দিনে ইউক্রেনের মারিউপোল শহরে আবারও বোমাবর্ষণ হয়েছে। ঐ শহরের কাউন্সিল টেলিগ্রামে একটি পোস্ট দিয়ে বলেছে যে রাশিয়ার বাহিনী শহরের কেন্দ্রে বৃষ্টির মতো বোমা ফেলছে। শহরটির মেয়রের দাবি, রুশ হামলা শুরুর পর সেখানে ১ হাজার ২০৭ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে। এখন তাদের গণকবর দেওয়া হচ্ছে। এদিকে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের দিকে অগ্রসর হচ্ছে রুশ সামরিক বহর। রুশ সেনারা শিগগিরই শহরটি ঘিরে ফেলবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত ২২ লাখ ইউক্রেনীয় রুশ হামলার মুখে দেশটি ছেড়ে গেছে। কিয়েভের মেয়র জানিয়েছেন, ইতিমধ্যে শহরের অর্ধেক বাসিন্দা বাস্ত্তচ্যুত হয়েছে। ইউক্রেনকে এই সংকটকালে বড় ধরনের সামরিক ও মানবিক সহায়তা দিতে চলেছে যুক্তরাষ্ট্র। বুধবার মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদে প্রায় ১ হাজার ৩৬০ কোটি মার্কিন ডলারের একটি সহযোগিতা প্যাকেজ অনুমোদন পেয়েছে। অন্যদিকে রাশিয়ার অভ্যন্তরে যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ বেড়ে চলেছে। দেশটিতে এখন পর্যন্ত ১৩ হাজারের বেশি মানুষকে বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার কারণে আটক করা হয়েছে।

ইউক্রেনে রুশ সেনাবাহিনী ক্লাস্টার ও ভ্যাকুয়াম বোমা ব্যবহার করেছে বলে আগেই অভিযোগ উঠেছে। এবার যুক্তরাষ্ট্র সতর্ক করে বলেছে যে, ইউক্রেনে রাসায়নিক বা জৈব অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে রুশ বাহিনী। বুধবার হোয়াইট হাউজের মুখপাত্র জেন সাকি এই আশঙ্কার কথা জানান। তিনি বলেন, রাশিয়া ইউক্রেনে রাসায়নিক বা জৈব অস্ত্র ব্যবহার করার প্রাথমিক প্রস্ত্ততি নিয়েছে। এ ব্যাপারে আমাদের সতর্ক হতে হবে।

জেন সাকি বলেন, ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্র জৈব ও রাসায়নিক অস্ত্রের ল্যাব পরিচালনা করছে বলে রাশিয়া যে দাবি করেছে তা অযৌক্তিক। বরং এই মিথ্যা দাবি করে মস্কো তাদের পরবর্তী উসকানিহীন হামলার ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার ‘নিশ্চিত ষড়যন্ত্র’ করছে। এর আগে কয়েকটি পশ্চিমা দেশের কর্মকর্তারাও এই আশঙ্কার কথা জানান। বিবিসিকে এক পশ্চিমা কর্মকর্তা বলেন, আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো যথেষ্ট কারণ রয়েছে। সিরিয়াতে রাশিয়ার মিত্রদের রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করতে দেখা গেছে।

কেমিক্যাল ওয়েপন্স কনভেনশন দেখভালকারী বৈশ্বিক সংস্হা- ওপিসিডব্লিউ বলছে, বিষাক্ত রাসায়নিককে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয় হত্যা বা ক্ষতিসাধনের জন্য। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুযায়ী যুদ্ধে এই ধরনের অস্ত্রের ব্যবহার নিষিদ্ধ।

মারিউপোল শহরের একটি শিশু হাসপাতালে বুধবার বোমা হামলার নিন্দা জানিয়ে এই ঘটনাকে ‘যুদ্ধাপরাধ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। কিয়েভ থেকে প্রকাশিত এক ভিডিও বার্তায় জেলেনস্কি বলেন, আজ আমাদের সবার একত্রিত হয়ে রাশিয়ার এই যুদ্ধাপরাধের নিন্দা জানাতে হবে। এই হামলা ‘ইউক্রেনে গণহত্যার চূড়ান্ত প্রমাণ’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি। হাসপাতালে ঐ হামলায় এক শিশুসহ তিন জন নিহত হয়েছে।

অন্যদিকে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ভাইসকে দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে জেলেনস্কি বলেছেন, রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন শিগগিরই আলোচনায় বসবেন এবং ইউক্রেনে আগ্রাসন বন্ধ করবেন। তিনি বলেন, রুশ সেনারা ইউক্রেনীয় সেনাদের প্রচণ্ড প্রতিরোধের মুখে পড়েছে। আমার মনে হয়, আমরা যে শক্তিশালী, পুতিন তা দেখতে পাচ্ছেন। তিনি আলোচনায় বসবেন। আলোচনাই যুদ্ধ সমাপ্তির একমাত্র উপায় বলে মনে করেন তিনি।

ইউক্রেনীয় সেনাদের চরম প্রতিরোধের মুখে ধীর হয়ে গেছে রুশ বাহিনীর অগ্রযাত্রা। ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, এখন পর্যন্ত ১২ হাজার রুশ সেনা প্রতিরোধ যুদ্ধে নিহত হয়েছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা বলছেন, যুদ্ধের প্রথম দুই সপ্তাহে রাশিয়ার আনুমানিক ৫ থেকে ৬ হাজার সেনা নিহত হয়েছে। সাধারণত নিহতদের চেয়ে আহতদের সংখ্যা তিন গুণ হয়।

তুরস্কের আন্তালিয়ায় রাশিয়া ও ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার যে বৈঠক হয়েছে, তাতে যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি হয়নি। বৈঠকের পর ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্র কুলেবা বলেন, রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী যেসব দাবি তুলে ধরেছেন, সেগুলো মানা হবে আত্মসমর্পণের সামিল। তবে তিনি জানান, দুই দেশই ইউক্রেনের মানবাধিকার সংকট অবসানে পদক্ষেপ নিতে সম্মত হয়েছে। তিনি বলেন, ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধ করা, বেসামরিক নাগরিকদের দুর্ভোগ লাঘব এবং রুশ দখলদার বাহিনীর হাত থেকে ইউক্রেনের অঞ্চল স্বাধীন করার প্রয়াসে এই আলোচনা চালিয়ে যেতে আমি প্রস্ত্তত।

এদিকে ইউক্রেনে ব্যাপক প্রতিরোধের মুখে পড়লেও রাশিয়া বিশেষ অভিযান পরিকল্পনা মাফিক চলছে বলে দাবি করেছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ। এ সময় তিনি অভিযোগ করেন যে, জীবাণু অস্ত্র তৈরির জন্য পেন্টাগন ইউক্রেনকে ব্যবহার করছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের অভিযোগকে ‘উদ্ভট’ বলে নাকচ করেছে।

তুরস্কে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠককে গুরুত্বপূর্ণ সূচনা বলে উল্লেখ করেছেন তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসলু। তুর্কি সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেন, মাত্র একটি বৈঠক থেকে অলৌকিক কিছু আশা করা ঠিক নয়। অনেক অসুবিধা সত্ত্বেও, আমি বলব একটি ভালো বৈঠক হয়েছে। আমরা মানবিক করিডর খোলা রাখার ওপর জোর দিয়েছিলাম।

ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব চেলসির রুশ মালিক রোমান আব্রামোভিচসহ সাত রুশ ধনকুবের বা অলিগার্কের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাজ্য সরকার। তাদের সম্পত্তি জব্দ করে দেওয়া হয়েছে। অনলাইনে পোস্ট করা যুক্তরাজ্যের কোষাগারের এক নথিতে বলা হয়েছে, আব্রামোভিচ একজন ‘ক্রেমলিনপম্হি অলিগার্ক’, যার সঙ্গে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।

খবর বিবিসি, সিএনএন ও আলজাজিরার।



Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked as *