ব্রাজিলে যেভাবে দ্রুত করোনা ছড়িয়ে পড়লো

বিশ্বের যেসব দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ সবচেয়ে প্রকটভাবে দেখা দিয়েছে, ব্রাজিল তাদের মধ্যে একটি। মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত ব্রাজিলে ২০ লাখেরও বেশি মানুষের মধ্যে করোনাভাইরাস সংক্রমণ হয়েছে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রাজিলে কোভিড-১৯ রোগীর সংখ্যা ২০ লাখ ১২ হাজার ১৫১ জন।

সংক্রমণের হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের পর ব্রাজিলই বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ দেশ। ব্রাজিলে এখন পর্যন্ত ৭৪ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে করোনাভাইরাস আক্রান্ত হয়ে, আর করোনাভাইরাস পরীক্ষা নিয়ে সন্দেহ থাকায় মৃত্যুর সঠিক সংখ্যাটা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে।

করোনাভাইরাস মহামারি ব্রাজিলের মূল ভূ-খণ্ডে আঘাত করতে বেশ সময় নিয়েছে। প্রথম ধাপে আমাজোনাস অঞ্চলের বাসিন্দাদের ওপর বড় ধরণের প্রভাব পড়ে করোনাভাইরাস সংক্রমণে। ব্রাজিলের রাজধানী মানাউসে শেষকৃত্য অনুষ্ঠান আয়োজন করে, এমন একটি প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মী কফিন সাজাচ্ছেন। ঐ এলাকার কফিনের মজুদ শেষ হয়ে যেতে পারে বলে কর্তৃপক্ষ আগেই সতর্ক করেছিল।

পরে মৃত্যুর সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকায় ঐ এলাকায় বিশাল আকারের গর্ত খুঁড়ে তারা। ভাইরাসের প্রকোপে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় আমাজন জঙ্গলের আশেপাশে থাকা নৃতাত্বিক গোষ্ঠীর মানুষ। তাদের অধিকাংশের বাড়ি থেকেই হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র বহুদুরে অবস্থিত।

মানাউসের শহরতলীতে নার্স ভ্যান্ডারলেসিয়া ওর্তেগা ৭০০ পরিবারের স্থানীয় সম্প্রদায়কে নিজ উদ্যোগে সাহায্য করেন। স্থানীয় মানুষজনও ওর্তেগাকে সাহায্য করেছিলেন তার কাজে। পরে আমাজন নদীর কাছে ঐ এলাকায় একটি কবরস্থান তৈরি করা হয়।

এরপর যখন সাও পাওলো আর রিও ডি জানেইরো’র মত বড় শহরগুলোতে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে, তখন ব্রাজিলে সংক্রমণের হার লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়া শুরু করে।

মে মাসে সাও পাওলোর মেয়র সতর্ক করেন যে তাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়তে যাচ্ছে এবং শহরটি করোনাভাইরাসের নতুন হটস্পট হয়ে উঠছে। সেসময় হাসপাতালের বেডের চাহিদা হয়ে ওঠে আকাশছোঁয়া। ঐ সময় শহরের একটি স্পোর্টস জিমে তৈরি হওয়া এই হাসপাতালটি ছিল জরুরি ভিত্তিতে চালু করা প্রথম হাসপাতালগুলোর একটি।

তবে করোনাভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকলেও দেশব্যাপী লকডাউন জারি করা হয়নি। বিভিন্ন রাজ্য এবং শহর তাদের নিজ নিজ প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন মাত্রার লকডাউন আরোপ করে।

তবে সেসময় ঘরে থাকার আদেশ জারি করার সমালোচনা করে ব্রাজিলের মানুষ, সমালোচনা করেন ব্রাজিলের কট্টর দক্ষিণপন্থী প্রেসিডেন্ট জেয়ার বোলসোনারোও। রাজধানী ব্রাসিলিয়ায় লকডাউন বিরোধী বিক্ষোভকারীদের সাথে বিক্ষোভেও যোগ দেন।

মহামারি সম্পর্কে বোলসোনারোর প্রতিক্রিয়া নিয়ে যথেষ্ট সমালোচনা হয়েছে। করোনাভাইরাসের ঝুঁকিকে তাচ্ছিল্য করে বারবার এই রোগকে তিনি ‘ছোট ফ্লু’ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বারবার মন্তব্য করেছেন যে ভাইরাসের চেয়ে আঞ্চলিক লকডাউন অর্থনীতির বেশি ক্ষতি করছে। ভীতি এবং আতঙ্ক ছড়ানোর দায়ে তিনি বারবার মিডিয়াকে দোষারোপ করেছেন।

ব্রাসিলিয়ার এই জনসমাগমের মত অনেক জায়গাতেই মাস্ক না পরেই সমর্থকদের সাথে আলোচনা করতে দেখা গেছে তাকে।

লকডাউন দিলে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্থ হবে – প্রেসিডেন্ট বোলসোনারোর এই ধারণার অনেক সমর্থক থাকলেও স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ কিন্তু এই মনোভাবের সমালোচনা করেছে সবসময়ই। মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে ব্রাজিলের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরে গেছেন দু’জন চিকিৎসক – একজন চাকরিচ্যুত হন, আর আরেকজন নিজেই পদত্যাগ করেন।

প্রেসিডেন্ট বোলসোনারো এমনও বলেছিলেন যে তিনি এই ভাইরাসে আক্রান্ত হবেন না। মার্চ মাসে এক বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, “আমি ছোট এই ফ্লুতে ঘায়েল হবো না।” তবে মাসখানেক পরেই তিনি করোনাভাইরাস আক্রান্ত হন।

প্রেসিডেন্ট বোলসোনারোর উপসর্গ দেখা যাওয়ার আগেরদিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত টড চ্যাপম্যানের সাথে সাক্ষাৎ করেন তিনি। ২০শে জুন বিশ্বের দ্বিতীয় দেশ হিসেবে দশ লাখের বেশি কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয় ব্রাজিলে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন সঠিকভাবে পরীক্ষা করা হলে এই সংখ্যা আরো কয়েকগুণ বেশি হতে পারে।

তবে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকলেও লকডাউন তুলে দেয়া হয়। রিও ডি জানেইরো ও সাও পাওলোতে খুলে দেয়া হয় রেস্টুরেন্ট ও পানশালা। ক্রমাগত করোনাভাইরাস রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া এবং লকডাউন শিথিল করায় ব্রাজিলিয়ানদের অনেকেই মনে করে যে তাদের নিজেদের পদক্ষেপ নিতে হবে।

সেই চিন্তা থেকেই হয়তো, এক দম্পতি নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশেষ পোশাক পরে রাস্তায় বের হওয়া শুরু করে। তবে আশার কথ হলো, হাজার হাজার ব্রাজিলিয়ান স্বেচ্ছাসেবীদের সহায়তায় দু’টি ব্রাজিলিয়ান ফার্মাসিউটিক্যাল ভ্যাক্সিন তৈরির চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। সূত্র: বিবিসি

Originally posted 2020-07-17 19:55:56.



Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked as *