রেল খাতের আরেক মিঠু আফসার বিশ্বাস! নেপথ্যে কারা?

করোনার সময় স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতি নিয়ে গণমাধ্যমে আলোচনায় আসে ঠিকাদার মিঠু সিন্ডিকেটের নাম। তেমনি বাংলাদেশ রেলওয়ের এক সিন্ডিকেটের নাম আফসার বিশ্বাস। এই আফসার বিশ্বাস যেন রেলের আরেক মিঠু। তার বাইরে এই রেলের বিভিন্ন কাজ কেউই পায় না। বলা চলে একচ্ছত্র আধিপত্য তার। কোনো টেন্ডার হলেই সেখানে নামে ও বেনামে একাই টেন্ডার অংশ নেন আফসার। এরপর কাজের সুবিধার্থে নিজের মতো করে কাজ ভেঙে ভেঙে করেন। আর এসবের নেপথ্যে রয়েছে রেলের কয়েকজন অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারী। তারা কোনো কিছু হলেই মেরামতের জন্য জরুরি চাহিদাপত্র অনুমোদনের তোড়জোড়ও শুরু করেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রেলের ট্রাকশন মোটর ও আর্মেচারের যত কাজ হয় তার সবটাই করেন এই আফসার বিশ্বাস। তবে এই সিন্ডিকেট পরিচালিত হয় যশোরের কয়েকজন ঠিকাদারদের দ্বারা। আর এদের নেতৃত্ব দেন আফসার বিশ্বাস। গত ১০ বছরে রেলের অনেক কাজ হয়েছে। বিশেষ করে রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রণ দফতর (সিওএস), কেন্দ্রীয় লোকোমেটিভ কারখানা, সৈয়দপুর ক্যারেজ কারখানা, চট্টগ্রামের পাহাড়তলী ক্যারেজ কারখানায় রয়েছে তার একক দাপট। টানা গত ১০ বছর থেকে অধিকাংশ কাজ করছেন এই আফসার বিশ্বাস। অভিযোগ আছে, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে তিনি রেল অফিসারদের নানাভাবে জিম্মি করেন। এরপর কাজ বাগিয়ে নেন। তবে তার বাইরে যাতে কেউ কাজ না পায় তার জন্য রয়েছে তার বিশাল সিন্ডিকেট। যারা বিভিন্ন সময়ে রেল অফিসারদের বদলির ভয়ভীতি দেখিয়ে কাজ আদায়সহ অন্য ঠিকাদারদেরও ভয়ভীতির সঞ্চার করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশ রেলওয়ে কেন্দ্রীয় লোকোমেটিভ কারখানা কেলোকা যেখানে পুরনো ইঞ্জিন মেরামত করা হয়। এই কারখানার তথ্য উপাত্ত বলছে, গত ১০ বছরে যত ইঞ্জিন মেরামতের কাজ হয়েছে তার সিংহভাগই করেছে আফসার বিশ্বাসের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বিশ্বাস কন্সট্রাকশন, বাঁধন এন্টারপ্রাইজ ও তার সহযোগী প্রতিষ্ঠান শ্রীজা মেটাল, রিপন মেটাল, এআর এন্টারপ্রাইজ, থ্রিএস এন্টারপ্রাইজ। তবে অবাক বিষয় হলো, আফসার বিশ্বাস সিন্ডিকেট ছাড়া এসব কাজ অন্য কেউ পায়নি। তবে এসব কাজের মান ও খরচ নিয়েও বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন উঠেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বিষয়গুলো জানার পরও আমলে নেয়নি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।

এদিকে কেলোকা কারখানায় করা আফসার বিশ্বাসের বেশ কিছু কাজের তথ্য-উপাত্ত এই প্রতিবেদকের কাছে এসেছে। জানা গেছে, রেলওয়ে লোকোমেটিভের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশের মধ্যে অন্যতম ট্রাকশন মোটর ও আর্মেচার। বাংলাদেশ রেলওয়ে বৈদেশিক তালিকাভুক্ত সরবরাহকারীদের মাধ্যমে নতুন ট্রাকশন মোটর ও আর্মেচার ক্রয় করে থাকে। অন্যদিকে স্থানীয়ভাবে দেশীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে রেলের প্রয়োজনীয় মেরামতও করা হয়ে থাকে। কিন্তু এই সিন্ডিকেটের প্রভাবে গত ২০১৪ সাল থেকে আজ অবধি যতগুলো টেন্ডার হয়েছে তার সবটাই ঘুরেফিরে নিয়ম নীতির তোয়াক্তা না করে পেয়েছে কেবল একটি মাত্র প্রতিষ্ঠান শ্রীজা মেটাল। তবে কাজগুলোর প্রতিটি উন্মুক্ত দরপত্রে তার সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে অংশগ্রহণ করে বিশ্বাস কন্সট্রাকশন ও বাঁধন এন্টারপ্রাইজ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সবকটাই আফসার বিশ্বাসের করা নামে-বেনামের প্রতিষ্ঠান।

প্রতিবছর তার প্রতিষ্ঠানের বাইরে কেউ টেন্ডারে অংশগ্রহণ করে না। ফলে তিনি এককভাবে সব কাজ পেয়ে থাকেন। কাগজপত্রে আলাদা প্রতিষ্ঠান দেখানো হলেও আসলে সেগুলো তারই প্রতিষ্ঠান।

পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা অনুযায়ী একই অর্থবছরে নির্দিষ্ট পরিমাণ চাহিদাসম্পন্ন এক জাতীয় মালামাল একবারে কেনার নিয়ম। বাংলাদেশ রেলওয়ের ক্রয় নীতিমালা অনুযায়ী অতিরিক্ত মহাপরিচালক রোলিং স্টকের (এডিজি) ক্রয়সীমা অনুমোদনের ক্ষমতা ৫০ লাখ; অন্যদিকে মহাপরিচালক (ডিজি) ক্রয়সীমা অনুমোদনের ক্ষমতা ২ কোটি। চাহিদামতো একসঙ্গে কাজ শেষ করতে গেলে অর্থের পরিমাণ তাদের ক্রয়সীমার ঊর্ধ্বে চলে যায়। তাই একই কাজকে বহুসংখ্যক চাহিদাপত্রের ভিত্তিতে কয়েকবারে ভেঙে ভেঙে ডিজি ও এডিজি ক্রয়সীমার মধ্যে রেখে সেই কাজ বাগিয়ে নেন আফসার বিশ্বাস এমন অভিযোগ রেলের প্রতিটি কর্মকর্তার মুখে মুখে।

এই প্রতিবেদকের হাতে আসা বেশ কিছু টেন্ডারের নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, ২০১৫ সালের ২০ এপ্রিল প্রতিটি ট্রাকশন মোটর মেরামতের জন্য ২১ লাখ টাকা মূল্যে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। পরে ২০১৭ সালের ৭ মার্চ প্রতিটি ট্রাকশন মোটর মেরামতের জন্য ১৯ লাখ ৯৯ হাজার ৯০০ টাকা মূল্যে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। আবার একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ২০১৯ সালের জুন মাসে লোকোমেটিভের ১২টি ট্রাকশন মোটর ও আর্মেচার মেরামতের প্রয়োজন হয়। ১২টি মেরামত খরচ ডিজির ক্রয়সীমা ক্ষমতা ঊর্ধ্বে চলে যাওয়ায় সেটিকে ভেঙে ছয়টি করে ভাগ করে আফসার বিশ^াস সিন্ডিকেট কাজ হাতিয়ে নেয়। আর এই কাজের প্রথম ধাপের মেরামতের খরচ দেখানো হয়েছে ৯৫ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। যেখানে প্রতিটির মেরামত খরচ পড়েছে ১৫ লাখ ৭৯ হাজার টাকা। অথচ বিভিন্ন বৈদেশিক সরবরাহকারীদের দেশীয় প্রতিষ্ঠানদের কাছ থেকে জানা গেছে, যে টাকা মেরামতের জন্য খরচ হয়েছে আর অল্প কিছু টাকা হলেই নতুন ট্রাকশন মোটর আর্মেচার কেনা সম্ভব ছিল। একই অর্থবছরের ২৬ জুন ছয়টি ট্রাকশন মোটর আর্মেচারের মেরামতের জন্য ৯৫ লাখ ৩৪ হাজার টাকা মূল্যের কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। একই টেন্ডারে নাম্বারে পার্ট কেসের ভিত্তিতে একই ট্রাকশন মোটর আর্মেচার আরও ছয়টির মেরামতের জন্য ৯৫ লাখ ৩৪ হাজার টাকা মূল্যের আরেকটি কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। যা রেলওয়ে নীতিবহির্ভূত বলছেন রেল সংশ্লিষ্টরা। আবার ২০২০ সালের ৩১ মে পাঁচটি ট্রাকশন মোটর মেরামতের জন্য ৯৯ লাখ ৯৯ হাজার টাকা মূল্যে দেওয়া হয়েছে। একই বছরের ৭ জুন পাঁচটি ট্রাকশন মোটর মেরামতের জন্য ৯৯ লাখ ৯৯ হাজার টাকা মূল্যে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। এসব নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, কখনও একই কাজ করেছেন বেশি মূল্যে। বিষয়গুলো সবার জানার পরও কেউ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, আফসারের মালিকাধীন বিশ্বাস কন্সট্রাকশন ও বাঁধন এন্টারপ্রাইজ রেলের ওয়াগন ও ক্যারেজ মেরামতের প্রকল্পগুলোর আওতায় সিংহভাগ যন্ত্রাংশ সরবরাহের শতকোটি টাকার কাজ এলটিএম টেন্ডারের ভিত্তিতে বাগিয়ে নিয়েছে। এ ছাড়াও নতুন কোচ সরবরাহের ক্ষেত্রেও তার ইশারায় টেন্ডার মূল্যায়ন হয়ে থাকে বলে অফিসারদের মুখে গুঞ্জন রয়েছে। রেলের যেসব ইঞ্জিন ব্যবহার অযোগ্য বাতিল এবং পরবর্তীতে সেগুলো আর চলবে বলে ঘোষণার পরও সেগুলো মেরামতের নামে কাজ বাগিয়ে নিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে এই আফসার সিন্ডিকেট বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা।

রেল বিভাগের ঠিকাদারির কাজ করেন এমন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সংশ্লিষ্টরা নাম প্রকাশ না করা শর্তে জানিয়েছেন, আফসার বিশ্বাসের কাছে অধিকাংশ রেল কর্মকর্তা অসহায়। নানা কারণে তাকে কাজ দিতে তারা বাধ্য হয়ে থাকে। এসব কারণে বিশ্বাস সিন্ডিকেটের ভয়ে অনেকেই দরপত্রে অংশ নিতে ভয় পান বলেও জানায় তারা। রেলওয়ে সূত্র জানিয়েছে, পার্বতীপুরে থাকা কেন্দ্রীয় লোকোমেটিভ কারখানার ভেতরে প্রধান নির্বাহীর বাংলোটি মাত্র আট হাজার টাকা চুক্তিতে দীর্ঘমেয়াদে বরাদ্দ পেয়েছে। অথচ সরকারি ভাড়া অনুযায়ী ওই বাংলোর ভাড়া ২০ হাজার। সেখানে তারা নিয়মবহির্ভূতভাবে কাজের পাশাপাশি থাকছেন বলেও জানা গেছে। শুধু কি তাই, সরকারি বিদ্যুৎ খরচও করছেন তারা। যা বছরের পর বছর বকেয়া বিলের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় কোটি টাকার কাছাকাছি। বিল পরিশোধের জন্য বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে তাগাদা দিলে তারা কর্মকর্তাদের বদলির ভয়ভীতি দেখান বলে অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে আফসার বিশ^াসের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।

বাংলাদেশ রেলওয়ে মহাপরিচালক মো. শামসুজ্জামান বলেন, এই খাতে তো অনেক প্রতিষ্ঠানই কাজ করে। তবে বিষয়টি আমার জানা নাই। তবে তাদের বিরুদ্ধে নির্দিষ্টভাবে কোনো অভিযোগ থাকলে সেটা পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Originally posted 2020-07-08 07:37:20.



Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked as *