ভুয়া ভ্যাকসিন চক্র থেকে সাবধান

কোভিড ভ্যাকসিন বাজারে এসে গেছে। তারই সঙ্গে বেড়েছে আশঙ্কা, ভুয়া ভ্যাকসিন চক্র কোভিডের ভ্যাকসিন জাল করছে না তো!
অ্যামেরিকা এবং ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে করোনার টিকাকরণ শুরু হয়েছে। এই সুযোগই ব্যবহার করে মানুষের ক্ষতি পারে অপরাধীরা। সতর্ক করল ইউরোপীয় ইউনিয়নের ক্রাইম এজেন্সি ইউরোপোল। তারা জানিয়েছে, ভুয়া ভ্যাকসিন বাজারে ছাড়তে পারে অপরাধীরা। সোমবার তারা একটি অনলাইন বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, অনলাইনে চোরাই ভ্যাকসিন বিক্রি করার চেষ্টা হতে পারে। সকলে যেন সতর্ক থাকেন।

ইউরোপোলের মুখপাত্র জ্যান ওপ জেন উর্থ ডিডাব্লিউকে বলেছেন, যত দিন যাবে, বাজারে ভ্যাকসিনের চাহিদা তত বাড়বে। আর তারই সুযোগ নেবে চোরাকারবারিরা। কালো-বাজারে তো বটেই, সাধারণ বাজারেও চোরাই ভ্যাকসিন চলে আসার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। ওই ভ্যাকসিন ভুল ভাবে তৈরি। ব্যবহারের যোগ্য নয়। চোরাকারবারিরা সেই ভ্যাকসিনই বেচার চেষ্টা করবে বলে সতর্ক করা হয়েছে।

গত মার্চেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সতর্কতা জারি করেছিল। বলা হয়েছিল, বেশ কিছু অনলাইন সাইটে বলা হচ্ছে, কোভিড চিকিৎসার ওষুধ তাদের কাছে আছে। এগুলি সব জাল।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্মকর্তা পারনেট বউরডিলোন ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, ”ভুয়া ওষুধ বিক্রির একটা চক্র তৈরি হয়েছে। অসংখ্য ওয়েবসাইটে এ সব ওষুধ বিক্রি হচ্ছে। নিজেদের চিকিৎসক ঘোষণা করে বহু মানুষ এ সব ওষুধ দিচ্ছেন। এক অদ্ভুত সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে।”

আট ডিসেম্বর বায়োনটেক ও ফাইজারের টিকার প্রথম ডোজ নেন ৯০ বছরের মার্গারেট৷ যুক্তরাজ্যে প্রথম আট লাখ টিকা পাবেন তার মতো প্রবীণ, সামনের সারির স্বাস্থ্যকর্মীসহ বাকি বয়স্ক নাগরিকরা৷ ফাইজারের কাছে মোট চার কোটি ডোজ টিকার অর্ডার দিয়েছে দেশটি; যার মাধ্যমে দুই ডোজ করে দুই কোটি মানুষের ভ্যাকসিনের নিশ্চয়তা মিলছে৷ পাঁচ কোটি ত্রিশ লাখ নাগরিকের সবাইকে টিকা দিতে যুক্তরাজ্যকে নির্ভর করতে হবে অন্য কোম্পানিগুলোর উপরে৷

কোভিডের ওষুধ বলে এ ধরনের একাধিক প্রোডাক্ট বাজারে ঘুরছে বলে ডাব্লিউএইচও আধিকারিক জানিয়েছেন। বেশ কিছু ওষুধ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে এবং কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

এই সমস্ত ভুয়া ওষুধ নিয়ে ইউরোপের মানুষের ভাবনার কারণ নেই। রেজিস্টার্ড ওষুধের দোকান থেকে জিনিস কিনলে ভুয়া ওষুধ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে আশ্বস্ত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

কেউ কেউ মনে করেন, শুধুমাত্র গরিব দেশেই ভুয়া ওষুধের চক্র গড়ে ওঠে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, গোটা বিশ্বেই এই সমস্যা আছে। ডাব্লিউএইচও-র বক্তব্য, পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ভুয়া ওষুধের চক্র আছে। এক সময় যা অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া দেশের সমস্যা ছিল, এখন তা সকলকে গ্রাস করেছে।

এই ওষুধগুলো থেকে কী ধরনের সমস্যা হতে পারে? বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, অধিকাংশ সময়েই এই ওষুধগুলি কোনোরকম কাজ করে না। তবে কখনো কখনো এগুলি বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। ভুয়া ওষুধ খেয়ে মানুষের মৃত্যুও হতে পারে।

তবে সব চেয়ে বড় কথা, ভুয়া ওষুধ খেয়ে গণস্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপর থেকে মানুষের আস্থা চলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ডাব্লিউএইচও-র বক্তব্য, রেজিস্টার্ড বাজারে যে ভ্যাকসিন ছাড়া হয়েছে, তা পরীক্ষার পরেই সকলের ব্যবহারের জন্য বিক্রি করা হচ্ছে। এর সঙ্গে ভুয়া ভ্যাকসিন গুলিয়ে ফেললে মুশকিল। সকলকে মনে রাখতে হবে, ভ্যাকসিন কিনতে হলে রেজিস্টার্ড দোকান থেকেই কিনতে হবে। সেই ভ্যাকসিন অবশ্যই কাজ করবে।

জার্মানির কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার নভেম্বরের শুরুতেই সারাদেশে কীভাবে ভ্যাকসিন দেয়া হবে সেই পরিকল্পনা নিয়েছে৷ ‘ন্যাশনাল ভ্যাকসিনেশন স্ট্র্যাটেজি’তে ১৫ পাতার পরিকল্পনা লেখা হয়েছে৷ যদিও টিকা পাওয়ার পর তা বিতরণের পরিকল্পনাকে একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবেই দেখছেন তারা৷ তারপরও চেষ্টা করছেন ভ্যাকসিন হাতে পাওয়ার সাথে সাথে বিশাল জনগোষ্ঠীকে যাতে এর আওতায় আনা যায়৷

২০১৬ সালে বিশ্বের ২৭টি উন্নত দেশে ভুয়া ওষুধের বাজার মূল্য ছিল চার দশমিক চার বিলিয়ন ডলার। এ ছাড়াও বহু দেশে ঘরোয়া ভাবে ভুয়া ওষুধ তৈরি হয়। যা দেশের বাইরে রপ্তানি করা হয় না। সেই সব ওষুধের বাজার মূল্য ধরলে সংখ্যাটা আরো বাড়বে বলে জানিয়েছে ডাব্লিউএইচও।

বিশ্বের প্রায় দুই বিলিয়ন মানুষ ঠিক ওষুধের নাগাল পান না। ভ্যাকসিন, মেডিক্যাল ডিভাইস কোনো কিছুই তাঁরা হাতের কাছে পান না। এই সুযোগটাকেই কাজে লাগায় ভুয়া ওষুধের চক্র।

গোটা বিশ্বে বছরে ৭২ থেকে এক লাখ ৬৯ হাজার শিশু নিউমোনিয়ায় মারা যায় কেবলমাত্র ওষুধ না পেয়ে। মূলত ভুয়া ওষুধে চিকিৎসা হয় তাদের। যে ওষুধ কোনো কাজই করে না। আরো এক লাখ ৬০ হাজার শিশুর মৃত্যু হয় ভুয়া ম্যালেরিয়ার ওষুধ খেয়ে।

কখনো কখনো ঠিক ভাবে তৈরি হওয়া ভ্যাকসিনও খারাপ হয়ে যায়, ভুয়া সরঞ্জাম ব্যবহারের জন্য অথবা পরিবহনের সময় তাপমাত্রা ঠিক না থাকার জন্য। ওই ভ্যাকসিনগুলিকে ফেলে দেওয়া হয়। ভুয়া ওষুধের চক্র সেই ফেলে দেওয়া ভ্যাকসিনও বিক্রি করে।

বায়োনটেক ফাইজারের কোভিড ভ্যাকসিন মাইনাস ৭০ ডিগ্রিরও কম তাপমাত্রায় স্টোর করতে হয়। বাভারিয়া অঞ্চল থেকে এমন ১০০০টি ভ্যাকসিন ফেরত পাঠানো হয়েছে। কারণ, তাপমাত্রার গণ্ডগোল হয়েছিল। জার্মানির অন্য প্রদেশগুলি থেকেও এমন বহু খবর মিলেছে। যারা ভ্যাকসিন ফেরত পাঠিয়েছে তাপমাত্রার হেরফেরের জন্য।

গত আগস্টে বিশ্বের প্রথম কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন নিবন্ধনের ঘোষণা দিয়েছিল রাশিয়া৷ সার্বিক পরীক্ষার আগেই নিবন্ধনের ঘোষণায় স্পুটনিক ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়ে সংশয় জেগেছিল৷ তবে নির্বিঘ্নেই শুরু হয়েছে ভ্যাকসিন দেয়া৷ ছবিতে রস্তভ-অন-দনে ভ্যাকসিন নিচ্ছেন এক সেনা সদস্য৷

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রশান্ত যাদব ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, খারাপ ভ্যাকসিন অথবা ভুয়া ভ্যাকসিন যে কোনো সময় সাপ্লাই চেনে ঢুকে পড়তে পারে। ভ্যাকসিন যখন এক দেশ থেকে অন্য দেশে ফ্লাইটে অথবা জাহাজে পাঠানো হচ্ছে তখন থেকে তার মধ্যে ভুয়া ভ্যাকসিন মিশিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। সেই ভ্যাকসিন যখন অন্য দেশে পৌঁছায় এবং দিকে দিকে বিলি করা হয়, এমনকী, ভ্যাকসিন ক্লিনিকে পৌঁছানোর পরেও ভুয়া ভ্যাকসিন তার মধ্যে মিশিয়া দেওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

যে ভাবে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ভ্যাকসিন পাঠানো হয়, তাতে এ কাজ করা খুব কঠিন কিছু নয়। কোভিড ভ্যাকসিনের চাহিদা যেহেতু বেশি, সেখানে ভুয়া ভ্যাকসিন মিশিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনাও বেশি। যত বেশি জায়গায় ভ্যাকসিন স্টোর করা হবে, ভুয়া ভ্যাকসিন মিশে যাওয়ার সম্ভাবনাও তত বাড়বে বলে মনে করেন যাদব। যাদবের মতে, ভুয়া ভ্যাকসিন মিশিয়ে দিলে তা ধরা পড়াও খুব কঠিন।

যাদবের মতে, বিভিন্ন মানুষের উপর ভ্যাকসিন সরবরাহের দায়িত্ব থাকে। ফলে সহজেই দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়াও সম্ভব। যিনি ভ্যাকসিন ফ্লাইটে তুললেন আর যিনি নামালেন তাঁরা দুজনেই মধ্যবর্তী সময়ে ভ্যাকসিনের বাক্সে ভুয়া ভ্যাকসিন মিশিয়ে দেওয়ার দায় এড়িয়ে যেতে পারেন। সাধারণত, যে সংস্থা ভ্যাকসিন বানাচ্ছে, দায় তাদের। সরকারের হাতে ভ্যাকসিন পৌঁছানো পর্যন্ত দায়িত্ব সংস্থার থাকে। ডেলিভারি হয়ে গেলে দায়িত্ব সরকারের। ফলে মধ্যবর্তী সময়ে ভুয়া ভ্যাকসিন মিশিয়ে দিলেও কারো কিছু বলার থাকে না।

তবে কোভিড ভ্যাকসিন জাল হচ্ছে কি না, তা বোঝার একটি সহজ ব্যবস্থা আছে। যে কাচের বোতলে কোভিড ভ্যাকসিন ভরা হচ্ছে, বাজারে সেই বোতল প্রায় শেষ। কেউ যদি ওই বোতল বড় সংখ্যায় কিনতে চায়, তাহলেই সতর্ক হতে হবে। দেখতে হবে, ওই ব্যক্তি কেন এত সংখ্যক বোতল কিনছেন। বায়োনটেকের ক্ষেত্রে ভ্যাকসিন খুবই কম তাপমাত্রায় স্টোর করতে হয়। এটাও ভুয়া ভ্যাকসিনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার একটি সহজ উপায়। বিশেষ ফ্রিজার ছাড়া এই ভ্যাকসিন সাপ্লাই করা সম্ভব নয়।

সাধারণত ভুয়া ওষুধ চেনা যায় তা দোকানে পৌঁছে যাওয়ার পরে। কখনো গ্রাহকের হাতে চলে যাওয়ার পরে। ফলে অধিকাংশ সময়েই প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলিকে চিহ্নিত করা যায় না। করা গেলেও প্রমাণের অভাবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। সংস্থাগুলি যথেষ্ট গোপনীয়তা মেনে এ কাজ চালায়।

ব্রাজিল, ক্যানাডা, ফ্রান্স, অ্যামেরিকা কিংবা যুক্তরাজ্যে ভুয়া ওষুধ তৈরির সর্বাধিক সাজা ছয় বছর। যেখানে নারকোটিকসের জন্য ২৫ বছর পর্যন্ত সাজা দেওয়া হয়।

Originally posted 2021-01-05 21:34:33.



Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked as *