যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আর মাত্র এক মাস বাকি। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা একদিকে যেমন নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা তৈরি করেছে, তেমনি আবার মার্কিন সংবিধানের নির্বাচন ও ক্ষমতা হস্তান্তর সংক্রান্ত বিভিন্ন খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে আলোচনাও বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে এ নিয়ে দেশটির সাধারণ জনগণের পাশাপাশি সরকারের ভেতরেও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা যাচ্ছে।

নির্বাচনের আগে কোনো প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর মৃত্যু বা অভিষেকের আগে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের মৃত্যু হলে বা প্রার্থী অক্ষম হয়ে পড়লে কী ঘটবে- উঠছে এ প্রশ্নও। এ ধরনের কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে যুক্তরাষ্ট্রের আইন এবং ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান দল তা কীভাবে সামলাবে। আলোচনায় আসছে নির্বাচন পেছানো কিংবা স্থগিত রাখার সম্ভাবনাও। সব মিলিয়ে মার্কিন ভোটারদের মধ্যে ব্যাপক কৌতূহল দেখা যাচ্ছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্স এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।

দেশটিতে আসন্ন ৩ নভেম্বরের নির্বাচন কি স্থগিত করা সম্ভব? হ্যাঁ, সম্ভব। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে এ ধরনের কিছু ঘটার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান কংগ্রেসকে নির্বাচনের তারিখ ঠিক করার এখতিয়ার দিয়েছে। দেশটির আইন অনুযায়ী, চার বছর পরপর নভেম্বরের প্রথম সোমবারের পরদিন মঙ্গলবার দেশটিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভোটের দিন নির্ধারণের বিধান রয়েছে। ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট এবং ৩ নভেম্বরের নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামা ট্রাম্প অসুস্থ হওয়ার পর এখন নির্বাচন স্থগিত বা পিছিয়ে দেওয়ার কোনো প্রস্তাব এলে ডেমোক্র্যাট নিয়ন্ত্রিত কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদ তাতে আপত্তি জানাবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। রিপাবলিকানদের হাতে থাকা সিনেটে প্রস্তাবটি হয়তো সহজেই পাস হয়ে যাবে; কিন্তু আটকে যাবে প্রতিনিধি পরিষদে। কংগ্রেসের দুই কক্ষের এই দড়ি টানাটাটি যুক্তরাষ্ট্রকে সাংবিধানিক সংকটের দিকে ঠেলে দিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এর আগে কখনোই প্রেসিডেন্ট নির্বাচন স্থগিত হয়নি।

কোনো প্রার্থী যদি নির্বাচনের আগে মারা যান, সেক্ষেত্রে কী হবে?

এক্ষেত্রে ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকান ন্যাশনাল কমিটি তাদের সদস্যদের প্রতি বদলি প্রার্থী ঠিক করার আহ্বান জানাতে পারবে। অবশ্য এবারের নির্বাচনের আগে এখন হাতে যেটুকু সময় আছে, তাতে প্রার্থী বদলানো প্রায় অসম্ভব।

আগাম ভোট শুরু হয়ে গেছে। এরই মধ্যে প্রায় ২২ লাখ ভোটার তাদের রায়ও জানিয়ে দিয়েছেন বলে জানিয়েছে ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকশনস প্রজেক্ট।

ডাকযোগে ভোটের ক্ষেত্রে অনেক রাজ্যে ব্যালট বদলানোর শেষ সময় পেরিয়ে গেছে। করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে এবার ডাকযোগে ভোটের হার বেশি হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এরই মধ্যে দুই ডজন রাজ্যে ডাকযোগে ভোট দিতে আগ্রহীদের কাছে মেইল ব্যালট পাঠিয়েও দেওয়া হয়েছে।

কংগ্রেস যদি নির্বাচন স্থগিত না করে, তাহলে রিপাবলিকান ট্রাম্প বা ডেমোক্র্যাট জো বাইডেনের মধ্যে একজনের মৃত্যু হলেও ভোটারদের এই দুই প্রার্থীর মধ্যে একজনকে বেছে নিতে হবে।

প্রার্থী যদি ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের আগে মারা যান, তাহলে?

ইলেকটোরাল কলেজ ব্যবস্থা অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি রাজ্য ও ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়াকে তাদের জনসংখ্যা অনুযায়ী যে ‘ইলেকটোরাল ভোট’ বরাদ্দ করা হয়, তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিতের মাধ্যমেই একজন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে চূড়ান্তভাবে বিজয়ী হন।

কে প্রেসিডেন্ট হবেন, তা ঠিক করতে এবার ইলেকটোরাল কলেজের ‘ইলেক্টর’ বা ভোটদাতারা ১৪ ডিসেম্বর একত্র হবেন। ৫৩৮টি ইলেকটোরাল ভোটের মধ্যে বিজয়ীকে ন্যূনতম ২৭০টি নিশ্চিত করতে হবে।

সাধারণত প্রতিটি রাজ্যের ‘ইলেক্টররা’ ওই রাজ্যে পপুলার ভোটে বিজয়ী প্রার্থীকেই সমর্থন দেন। কিছু কিছু রাজ্য ‘ইলেক্টর’দেরকে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার স্বাধীনতা দিলেও যুক্তরাষ্ট্রের অর্ধেকের বেশি রাজ্যে এমন স্বাধীনতা নেই। সেখানকার ‘ইলেক্টর’দের পপুলার ভোটে বিজয়ী প্রার্থীকেই ভোট দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে কোনো প্রার্থীর মৃত্যু হলে পপুলার ভোটে জয়ী প্রার্থীকে বেছে নেওয়ার যে বাধ্যবাধকতা ‘ইলেক্টর’দের ওপর থাকে, তা বলবৎ থাকবে কি না, বেশিরভাগ রাজ্যেই তা সুনির্দিষ্ট করে উল্লেখ করা নেই।

মিশিগানের আইন অনুযায়ী, রাজ্যে পপুলার ভোটে বিজয়ী যে প্রার্থীর নাম ইলেকটোরাল কলেজ ব্যালটে থাকবে, ‘ইলেক্টর’দেরকে তাকেই ভোট দিতে হবে। অন্যদিকে ইন্ডিয়ানার আইন অনুযায়ী, ‘ইলেক্টর’রা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থীর মৃত্যু হলে তার বদলি প্রার্থীকে ভোট দেবেন।

কোনো প্রার্থীর মৃত্যু হলে, তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া দল আদালতে গিয়ে ‘ইলেক্টরদের’ মৃত প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার বাধ্যবাধকতা তুলে দেওয়ার আবেদন জানাতে পারে বলে মনে করছেন জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব পলিটিকাল ম্যানেজমেন্টের পরিচালক লরা ব্রাউন।

তিনি বলেন, সবচেয়ে আগ্রহোদ্দীপক প্রশ্ন হতে যাচ্ছে, সুপ্রিম কোর্ট এ ধরনের বিতর্ক কীভাবে মোকাবিলা করবে।

লয়োলা ল স্কুলের অধ্যাপক জাস্টিন লেভিট অবশ্য ইলেকটোরাল কলেজ ভোটে ওলটপালট দেখা যাবে না বলেই মনে করছেন। প্রার্থীর মৃত্যু হলেও, নির্বাচনে সুনির্দিষ্টভাবে কারো জয় নিশ্চিত হওয়ার পর অন্য দলগুলোর জনরায়কে অবজ্ঞা করার সম্ভাবনা কম, বলছেন তিনি।

ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের পর ৬ জানুয়ারি কংগ্রেস ওই ভোটের ফল পর্যালোচনা করে দেখবে; এরপরই কে হতে যাচ্ছে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট, তা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত হবে।

প্রশ্ন উঠছে, বিজয়ী প্রার্থী যতি ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের পর, কিন্তু ৬ জানুয়ারির আগে মারা যান, তখন কংগ্রেস কীভাবে এ পরিস্থিতি সামলাবে?

যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ২০তম সংশোধনী অনুযায়ী, অভিষেকের আগে যদি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভোটে জয়ী প্রার্থীর মৃত্যু হয়, তাহলে তার রানিং মেট, যিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করেছিলেন, তিনিই পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হবেন।

কিন্তু কখন একজনকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিজয়ী প্রার্থী’ বলা হবে? ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের পর, নাকি কংগ্রেসে পর্যালোচনা পর? এ কারণেই ১৪ ডিসেম্বরের পর কিন্তু ৬ জানুয়ারির আগে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থীর মৃত্যু হলে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে আইনি লড়াই শুরু হবে বলে ধারণা অনেক বিশ্লেষকের।

কংগ্রেস যদি মৃত প্রার্থীর পাওয়া ভোট খারিজ করে দেয় এবং সিদ্ধান্ত নেয় যে কেউই সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেনি; সেক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ইলেক্টোরাল ভোট পাওয়া তিনজনের মধ্যে একজনকে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেছে নেওয়ার ভার পড়বে প্রতিনিধি পরিষদের হাতে।

নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পাশাপাশি কংগ্রেসের ৪৩৫ আসনের সবগুলোতে নির্বাচনও হতে যাচ্ছে; ফলে এক্ষেত্রে কী যে ঘটবে তা বলা মুশকিল। যুক্তরাষ্ট্রে এখন পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী কোনো প্রার্থীর অভিষেকের আগে মৃত্যু হয়নি। কংগ্রেস কোনো প্রার্থীকে নির্বাচনে জয়ী ঘোষণার পর যদি অভিষেকের আগে তার মৃত্যু হয়, সেক্ষেত্রে কী হবে?

যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান অনুযায়ী, নির্বাচনী জয়ী প্রার্থীকে কংগ্রেসের পর্যালোচনার দুই সপ্তাহ পর, ২০ জানুয়ারি শপথ নিতে হয়। এ সময়ের মধ্যে যদি ওই বিজয়ী প্রার্থী মারা যান, তাহলে তার রানিং মেটই ২০ জানুয়ারি পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেবেন।



Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked as *