ধর্ষণবিরোধী মহাসমাবেশে ৯ দফা, লংমার্চের ঘোষণা

দেশব্যাপী অব্যাহত ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে আন্দোলনের পঞ্চম দিনেও প্রতিবাদে মুখর হয়ে ছিল রাজধানীর শাহবাগ। পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী শুক্রবার বিকাল থেকে শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে আয়োজিত মহাসমাবেশ আন্দোলিত ছিল ধর্ষণের বিরুদ্ধে স্লোগান, ব্যানার ও ধর্ষণবিরোধী সাংস্কৃতিক পরিবেশনায়।

সমাবেশ থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগসহ নয় দফা দাবি জানানো হয়। দাবি না মানলে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ পর্যন্ত লংমার্চসহ কয়েক দফা কর্মসূচিও ঘোষণা করা হয়। ‘ধর্ষণ ও বিচাহীনতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ’- এর ব্যানারে এই সমাবেশের আয়োজন করা হয়।

সমাবেশের শুরুতে ধর্ষণবিরোধী গণসংগীত, আবৃত্তি এবং নাটক পরিবেশন করেন উদীচী, নিহারঞ্জন, চারণসহ বিভিন্ন শিল্পীগোষ্ঠী। এরপরেই আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় মহাসমাবেশ।

বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক অনক রায়ের সঞ্চালনায় সমাবেশে বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি মনোয়ার হোসেন মাসুদ, জাহিদ সুজন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক আল কাদেরী জয়সহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা।

এছাড়াও সমাবেশে সংহতি জানিয়ে বার্তা পাঠিয়েছেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ইংরেজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম এম আকাশ, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. কাবেরী গায়েন, অধ্যাপক ড. গীতিআরা নাসরিন, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সামিনা লুৎফা, সাংবাদিক আবু সাঈদ খান প্রমুখ। সমাবেশে বাম ধারার ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরাসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা উপস্থিত হন।

সমাবেশে তানজিম উদ্দিন খান বলেন, ‘পুরো রাষ্ট্রই প্রতি মুহূর্তে ধর্ষিত হচ্ছে। কেননা এ রাষ্ট্র অন্যায্যতার মধ্যে রয়েছে। বিভিন্ন উপায় ও কায়দায় অন্যায্য ব্যবস্থাপনার কারণে রাষ্ট্র ধর্ষিত হচ্ছে। পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থা সংগঠিত ভন্ডামির শিকার হচ্ছে। নারীর প্রতি সহিংসতা এরই উদাহরণ। এই অন্যায্য রাষ্ট্র ব্যবস্থা দূর করতে হলে ধর্ষণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে।’

তানজিম বলেন, ‘ক্ষমতার সঙ্গে ধর্ষকের সম্পর্ক না থাকলে তারা এতো দুর্বিনীত হয়ে উঠত না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য দেখলে বোঝা যায়, ছাত্রলীগের ধর্ষককে মদদ দিচ্ছেন বড় বড় নেতারা। যারা ধর্ষকদের পাহারাদার তাদের বিরুদ্ধেও একত্রিত হতে হবে।’

বক্তারা বলেন, ‘সারাদেশে বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা-মামলা করা হয়েছে। কিন্তু আমরা সরকারকে জানিয়ে দিতে চাই, তাদের টিয়ারশেলের ঝাঁঝ যত হবে, আমাদের আন্দোলন ততই তীব্রতর হবে। সরকার বিভিন্ন জায়গায় বলছে যে, ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হবে। কিন্তু এই রায় দেয়া হলেও উচ্চ আদালতে তা পরিবর্তন হয়ে যাবে। তাই ধর্ষণ বন্ধে শুধু সর্বোচ্চ শাস্তি দিলেই হবে না। ধর্ষণ স্থায়ীভাবে বন্ধের জন্য বিকল্প ব্যবস্থাও ভাবতে হবে।’

৯ দফা দাবি উপস্থাপন

সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন প্রিন্স স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগসহ ধর্ষণ ও বিচারহীনতার বিরুদ্ধে নয় দফা দাবি তুলে ধরেন। তাদের অন্যান্য দাবিগুলো হলো- ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসতার সঙ্গে যুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত; পাহাড়-সমতলে আদিবাসী নারীদের উপর সামরিক-বেসামরিক সকল প্রকার যৌন ও সামাজিক নিপীড়ন বন্ধ করা; হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সরকারি বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানে নারী নির্যাতনবিরোধী সেল কার্যকর করা; সিডো সনদে বাংলাদেশকে স্বাক্ষর ও তার পূর্ণ বাস্তবায়ন করা ও নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক সকল আইন পত্যাহার করা; ধর্মীয়সহ সবধরনের সভা-সমাবেশে নারীবিরোধী বক্তব্য শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা।

সাহিত্য-নাটক-সিনেমা-বিজ্ঞাপনে নারীকে পণ্য হিসেবে উপস্থাপন বন্ধ করা, পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণে বিটিসিএলের কার্যকরী ভূমিকা নেয়া ও সুস্থ ধারার সংস্কৃতি চর্চায় সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করা; তদন্তের সময় ভিকটিমকে মানসিক নিপীড়ন ও হয়রানি বন্ধ করে ভিকটিমের আইনগত ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা; অপরাধ বিজ্ঞান ও জেন্ডার বিশেষজ্ঞদের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে অন্তর্ভুক্ত করা ও ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বাড়িয়ে অনিষ্পন্ন সকল মামলা দ্রুত নিষ্পন্ন করা; ধর্ষণ মামলার ক্ষেত্রে সাক্ষ্য আইন ১৮৭২-১৫৫(৪) ধারা বিলোপ করা এবং মামলার ডিএনএ আইনকে স্বাক্ষ্য প্রদানের ক্ষেত্রে কার্যকর করা; পাঠ্যপুস্তকে নারীর প্রতি অবমাননা ও বৈষম্যমূলক যেকোনো প্রবন্ধ নিবন্ধ পরিচ্ছেদ ছবি নির্দেশনা ও শব্দচয়ন পরিহার করা এবং গ্রামীণ শালিসের মাধ্যমে ধর্ষণের অভিযোগ ধামা চাপা দেওয়ার চেষ্টাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা।

দাবি আদায় না হলে লংমার্চের ঘোষণা

এসময় তাদের পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করেন অনিক রায়। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- প্রতিদিন বিকাল চারটা থেকে রাত পর্যন্ত শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচি পালন করা। অবস্থান পালনকালে ১১ অক্টোবর শাহবাগে ধর্ষণবিরোধী আলোকচিত্র প্রদর্শনী, ১২ অক্টোবর ধর্ষণবিরোধী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ১৩ অক্টোবর চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, ১৪ অক্টোবর নারী সমাবেশ এবং ১৫ অক্টোবর নারীদের সাইকেল র‌্যালি করা হবে। তাদের দাবিগুলো মানা না হলে ১৬ ও ১৭ অক্টোবর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ পর্যন্ত লংমার্চ করা হবে বলেও ঘোষণা দেয়া হয়।

বক্তৃতা শেষে প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এছাড়া একই সময়ে জাদুঘরের সামনে ‘ধর্ষণ ও বিচারহীনতাবিরোধী আন্দোলন’-এর ব্যানারে ধর্ষণবিরোধী কনসার্টেরও আয়োজন করা হয়।

Originally posted 2020-10-09 22:07:22.



Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked as *