কঠিন সংকটে দেশের শিল্পখাত

কঠিন সময় অতিক্রম করছে দেশের শিল্পখাত। বিশ্ববাজারে শিল্পের কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় এ সংকট। দেশীয় বাজারের জন্য যে পণ্য উৎপাদন করা হয় তার দাম বাড়িয়ে দিয়ে উদ্যোক্তারা ক্ষতি পুষিয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু রপ্তানি খাতের উদ্যোক্তারা পড়েছেন মহাসংকটে। কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় পণ্যেও উৎপাদন খরচ বাড়ছে। কিন্তু আমদানিকারকরা এ বাড়তি দাম দিতে নারাজ। দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, অবস্থা এমন চলতে থাকলে আগামী দুমাসের মধ্যে অনেক মাঝারি মানের কারখানা কর্মক্ষমতা হারাবে।
উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনার প্রাদুর্ভাবের সময়ে শিল্পের উৎপাদনে শ্লথগতি থাকায় কাঁচামালের বিষয়ে তেমন মাথা ঘামাননি তারা। কিন্তু করোনার প্রাদুর্ভাব কমে আসার সাথে সাথে বিশ্ববাজারে পণ্যের চাহিদা বেড়েছে। উদ্যোক্তা হুমড়ি খেয়ে লেগেছেন কাঁচামাল যোগাড়ে। এ সুযোগ নিচ্ছে কাঁচামাল সরবরাহকারীরা। এমন কিছু নেই যেগুলোর দাম বাড়েনি। তৈরি পোশাকের প্রধান কাঁচামাল তুলা থেকে শুরু কওে কাগজ, জ্বালানী, খাদ্যপণ্যরর কাঁচামাল সবকিছুর দাম বাড়তি। তবে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকের উদ্যোক্তারা পড়ছেন খুব ঝামেলায়। উৎপাদকদের সাথে কথা বললে তারা জানান, সংকট এখন উভয়মুখি। শ্রমিকদের বেতন ভাতা পরিশোধের পাশাপাশি ব্যাংক ঋণ শোধ করা এখন দায় হয়ে পড়েছে। তুলার দাম বেড়ে যাবার কারণে স্থানীয়ভাবে কাঁচামাল সংগ্রহ করা যেমন ব্যয়সাধ্য আবার আমদানি করা কাঁচামালেও একই অবস্থা।

ইউরোপের বড় রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান হান্নান গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সহ-সভাপতি এবিএম সামছু্দ্দিন বলেছেন, ক্রেতাদের এখন যে পণ্য সরবরাহ করা হচ্ছে তার অর্ডার পূর্বেই নেয়া হয়েছে। তখনকার কাঁচামালের দামের ওপর নির্ভর করে পণ্যের দাম ঠিক করা হয়েছিলো। কিন্তু এখন কাঁচামালের দাম বেড়ে গেলেও ক্রেতারা পোশাকের দাম বাড়াচ্ছে না। কোন কোন ক্রেতা রপ্তানিকারকদের সাথে বাড়তি দাম সামান্য ভাগাভাগি করলেও অধিকাংশই বহন করতে হচ্ছে রপ্তানিকারকদের। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, প্রতি পিস সোয়েটারের অর্ডার নেয়া হয়েছিলো আট মার্কিন ডলারে। এখন সেটির উৎপাদনের ব্যয় গিয়ে ঠেকেছে প্রায় নয় মার্কিন ডলারে। বাড়তি অর্থের কিছুটা আমদানিকারকরা শেয়ার করছেন। কিন্তু এটি একবারেই নগণ্য। আবার কোন কোন অমদানিকারক বলছেন, বাড়তি ব্যয়ের সামান্যও তার ব্যয় করবেন না। এতে অনেক কারখানা পড়েছে সমস্যায়।
এদিকে, শুধু কাঁচামালই নয়, সমুদ্র পরিবহনে খরচ বেড়ে যাবার ফলেও উদ্যোক্তারা পড়েছেন সমস্যায়। আন্তর্জাতিক বাজারে তুলার দাম বেড়ে যাবার ফলে দেশীয় বাজারে সুতার দাম বেড়ে যাওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু বাড়তি তুলার দামের সাথে যোগ হচ্ছে অতিরিক্ত পরিবহন খরচ। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস এসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন ইত্তেফাককে বলেন, আমাদের দেশে কোনো জাহাজ আসতে চায় না। কারণ এখানে পণ্য খালাসে বিলম্ব হয়। তিনি বলেন, তুলার দাম কোন দুনিয়াজোড়া সব কাঁচামালের দাম বেড়েছে। কিন্তু আমাদের বন্দরের সমস্যার কারণে আমদানি খরচ অনেক বেড়েছে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, প্রতি পাউন্ড তুলার দাম আন্তর্জাতিক বাজারে যা পড়ে তার চেয়ে দেড় থেকে দুই সেন্ট বেশি খরচ করতে হয় আমাদের জাহাজের জটিলতার কারণে। এমনিতে সামুদ্রিক পরিবাহন ব্যয় অনেক বেড়েছে। এর সাথে আমাদের বন্দরের সক্ষমতার অভাবে উদ্যোক্তারা বাড়তি অর্থ গুনছেন। তিনি এ বিষয়ে গভীর মনোযোগ দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

শুধু দেশে উৎপাদিত কাঁচামালই নয়, আমদানি করা কাঁচামালেরও দাম বেড়েছে এই সময়ে। বাংলাদেশের অধিকাংশ কাঁচামাল আসে চীন থেকে। সেখানকার সরকার বিদ্যুতের রেশনিং করায় কোন কোন কারখানা দৈনিক আট ঘণ্টার বেশি উৎপাদনে থাকতে পারছে না। এতে করে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে পণ্যের মান খারাপ হচ্ছে। আবার সময়মতো কাঁচামালও পাওয়া যাচ্ছে না। রপ্তানিকারকদের জন্য এটিও চিন্তার কারণ। উদ্যোক্তা এবিএম সামছুদ্দিন বলেন, আমদানিকারক দেশগুলোতে এখন নানা ডিজাইনের পণ্য সরবরাহ কতে হয়। একটি পণ্যের কাঁচামাল বিভিন্ন দেশ থেকে সংগ্রহ করতে হয়। যেহেতু চীন থেকে অনেক কাঁচামাল আসে সেহেতু এ খাতে ভবিষ্যতে সংকট আরও বাড়বে।

এদিকে, গত দুই বছরে দেশে অনেকগুলো কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। শিল্পাঞ্চল পুলিশের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, করোনা শুরু হবার পর থেকে এখন পর্যন্ত মোট ৬৩০টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। ঢাকা, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ এবং খুলনার চিত্র এটি। তবে অন্যান্য জায়গায় কত সংখ্যক কারখানা বন্ধ হয়েছে তার হিসাব পাওয়া যায়নি। শিল্পাঞ্চল পুলিশের হিসাব অনুযায়ী যেসব কারখানা করোনাকালে বন্ধ হয়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স এন্ড এক্সপোটার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) ১৩০টি, বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোটার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) ৭২টি, বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) ২৩টি মিল রয়েছে। এ বিষয়ে বিজিএমইএর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক এমডি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী ইত্তেফাককে বলেন, যে কারখানাগুলো বন্ধ হয়েছে সেগুলোতে গড়ে পাঁচ’শ থেকে সাত’শ শ্রমিক বেকার হয়েছে। কর্মহীন হয়ে পড়েছেন অনেকে। তিনি আরও বলেন, করোনাকালীন সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে তুলার দাম বেড়ে যাবার ফলে সুতার দামও বেড়েছে। এতে অনেক কারখানা লোকসান গুনছে।

Originally posted 2021-11-19 05:57:30.



Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked as *