বাজেট নিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের ভাবনায় ‘কোনটির দাম বাড়লো-কমলো’

জিডিপি বোঝে না, প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নূন্যতম মাথায় ঢোকে না। ফলে বাজেট নিয়ে সাতক্ষীরার কলারোয়ার বেশিরভাগ সাধারণ মানুষের তেমন ভাবনা নেই। তাদের মূল চিন্তার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে কোন জিনিসের দাম বাড়লো নাকি কমলো সেটার দিকেই।
আবার প্রস্তাবিত বাজেট পাসের আগেই যেসব পণ্যের দাম বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে সেগুলো ইতোমধ্যে দাম বাড়িয়ে বিক্রি করা হচ্ছে অথবা কৃত্রিম সংকটে উধাও হয়ে গেছে। তবে যেসব পণ্যের দাম কমার কথা বলা হয়েছে সেগুলো আগের মতোই আছে।

মহামারি করোনায় স্তব্ধ এখন পুরো বিশ্ব। চরম ঝুঁকির মুখে পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতি, বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। সামনে ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। মহামারির এই সংকটের মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ। গত ১১ জুন জাতীয় সংসদে পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে ঘোষিত বাজেট নিয়ে ইতোমধ্যে নানা মহলে নানান প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। তবে এবারের বাজেট নিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ মানুষেরা কি ভাবছেন? চায়ের দোকানে, বাজারের অলিতে গলিতে, মাঠেঘাটে ঘুরে সাধারণ মানুষের ভাবনা তুলে আনার চেষ্টা করেছি আমরা।

কলারোয়া উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি গ্রামের চায়ের দোকনে হঠাৎ গিয়ে একটি গল্পের মজলিশ থেকে শুনলাম- ‘কত বাজেট আইলো গেলো, গরীবের কি লাভটা হলো। বছর বছর শুধু বাজেট বাজেট আর বাজেট, সব জিনিসের দাম বাড়তেই আছে, কিন্তু আমাদের অবস্থার পরিবর্তন কতটুকু হচ্ছে?’

ভ্যান চালাক কুদ্দুস আলীর কাছে বাজেট নিয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করতেই তিনি রেগে যান। বলেন- ‘বাজেট ফাজেটের খবর আমরা রাখি না। আমার মতো সামান্য ভ্যান চালকের জন্য এসব বাজেট না। বাজেট হয়েছে জিনিসপত্রের দাম সব বেড়েছে। সাধারণ মানুষের কি লাভটা এখানে হয়েছে?’

উপজেলার সোনাবাড়ীয়া বাজারের মাতৃছায়া টেলিকমের রিফাদুজ্জামান সুমন বলেন, ‘সরকার বাজেট ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু জিনিসের দাম বেড়ে গেছে। গ্রামের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জন্য এটা কষ্টের।’
প্রস্তাবিত বাজেটটি পাস হওয়ার আগে তিনি সরকারকে কিছু বিষয়ে নজর দেওয়ার আহবান জানান।

তিনি আরও বলেন, ‘ঘোষিত বাজেট পাস হওয়ার আগেই মোবাইল ফোনের কলরেট ও ইন্টারনেট খরচ বেড়ে গেছে বলে কোম্পানি ম্যাসেজ দিচ্ছে। এর ফলে গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রার উপর প্রভাব পরার আশঙ্কা রয়েছে।’

আব্দুস সাত্তার নামে এক যুবক বলেন- ‘প্রতি বাজেটে ফোনের কলরেট ও ইন্টারনেট খরচ বাড়ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ বির্নিমানে এটা আরও সহজ লভ্য করা অত্যবশ্যকীয়। বিশেষ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলো দাম বাড়ানো হলে নিম্ন আয়ের মানুষের ভোগান্তি আরও বাড়বে।’
প্রস্তাবিক বাজেটটি পাস হওয়ার আগে বিষয়টি বিবেচনার আহবান জানান তিনি।

মুদি দোকানদার মিলন হোসেন জানান, ‘সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে মহামারিকালীন এবারের বাজেটে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলোর দাম বাড়লে নিম্ন আয়ের মানুষেরা আরও সংকটে পড়ে যাবে।’

ইজিবাইক চালক মনির হোসেন বলেন- ‘বাজেট প্রতি বছর আসছে। এবার টিভিতে শুনছি চাল-ডাল, মাছ-মাংসের দাম কমবে। এটা ভালো খবর। তবে, আমরা তো আর এত কিছু বুঝি না। ডাল-ভাতসহ নিত্যপণ্যের দাম কমে পাইলেই খুশি।’

আনছার মোল্লা নামে এক কৃষক জানান- ‘সার, কীটনাশকের দাম বাড়লে কৃষিতে চরম প্রভাব পড়বে। কৃষক ও কৃষি না বাঁচালে এই বাজেট দেশ বাঁচাবে কিভাবে?’

‘সংকটকালীন সময়ের এই বাজেটে সাধারণের মানুষের প্রত্যাশাটা কম নয়’- এমন মন্তব্য করে গয়ড়া বাজারের ক্ষুদ্র মোবাইল ফোন বিক্রেতা সাইফুল ইসলাম সেন্টু বলেন- ‘জিডিপি-প্রবৃদ্ধি বোঝে না, গ্রামের সাধারণ মানুষের ভাবনা মূলত কোন জিনিসের দাম বাড়লো নাকি কমলো সেটার দিকেই।’

প্রস্তাবিত বাজেটে স্বর্ণের দাম কমার কথা বলা হয়েছে। এ বিষয়ে কলারোয়া বাজারের স্বর্ণ অলংকারের কারিগর মিলন দত্ত বলেন- ‘করোনার প্রাদুর্ভাবে তাদের কাজ নেই। অনেক ব্যবসায়ী দোকান বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছেন। স্বর্ণের দাম কমলে কাজ বৃদ্ধি পাবে। এতে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয় খুশি হবে।’
আসছে কোরবানি ঈদের আগে স্বর্ণের দাম কমা বাস্তবায়ন হলে ঈদের সময় কাজ বৃদ্ধি পাবে বলে তিনি মনে করেন।

সিগারেট ও তামাকজাতীয় পণ্যের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবনা রয়েছে এই বাজেটে। তবে কলারোয়া বাজারের মোটরপার্টস ব্যবসায়ী মঞ্জুরুজ্জামান বলছেন- ‘বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সিগারেটের দাম এরইমধ্যে বৃদ্ধি করে নেয়া হচ্ছে। আবার অনেকক্ষেত্রে পাওয়া যাচ্ছে না।’

উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি প্রধান শিক্ষিক আখতার আসাদুজ্জামান চান্দু বলেন- ‘প্রত্যেকটা বাজেটে সর্বস্তরের মানুষের প্রত্যাশা থাকে। এবারের বাজেটেও মানুষের প্রত্যাশাটা কম নয়। তবে এবারের বাজেট এসেছে সংকটকালীন সময়ে। এই বাজেট নিয়ে নানা মহলে নানান প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। ‘অর্থনৈতিক উত্তরণ এবং ভবিষ্যত পথ পরিক্রমা’ শিরোনামে ঘোষিত বাজেটে মোবাইল কল রেটে এবং ইন্টারনেট ব্যবহারে খরচ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে এটির একটি প্রভাব পড়বে বলে আমি মনে করি। এখন সর্বক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার। প্রযুক্তির আরও বিকাশ ঘটাতে ডিজিটাল বাংলাদেশের লক্ষ্যে পৌঁছাতে ইন্টারনেট সহজলভ্য করা দরকার।’

তিনি আরও বলেন- ‘শহর নয়, গ্রামের সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে ফোনের কলরেট, ইন্টারনেট খরচ সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্রের দাম বিবেচনা করা আবশ্যক। তবে করোনাভাইরাসের দুঃসময়ে এই বাজেট বাস্তবায়ন সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ হবে বলে মনে করি।’

হিসাববিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ও কলারোয়া সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আবু নসর বলেন, ‘শিক্ষাখাতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ ইতিবাচক। শিক্ষক বাঁচলে শুধু শিক্ষা সেক্টর নয় সামগ্রিকভাবে দেশের উন্নতি হবে।’

তিনি আরো বলেন, ‘বাজেটে আয় ছাড়া ব্যয় বেশি হলেও সরকার নিশ্চয়ই সেটার সংস্থানের ব্যবস্থা করবে। কারণ এর আগেও ঘাটতি বাজেট সমুন্নত হয়েছে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো বরাদ্দের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন, যেটায় সাধারণ জনগণ উপকৃত হয়।’

Originally posted 2020-06-18 11:58:32.



Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked as *