লণ্ডভণ্ড লেবাননের ভবিষ্যৎ কোন পথে?

লেবাননের রাজধানী বৈরুতের বন্দরে যে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে তা দেশটির রাজনীতির পটপরিবর্তনের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। বিস্ফোরণে আড়াইশোর বেশি মানুষের মৃত্যুর পাশাপাশি ৬ হাজারের বেশি মানুষ আহত হন। লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় শহরের বড় একটি অংশ। এই ঘটনা লেবাননের নাগরিকদের রাজনৈতিক পুনর্গঠনের আন্দোলনকে আরো বেগবান করে, যা গতবছরের অক্টোবর থেকে চলছে। বিপুল পরিমাণ ঋণের ভার, আর অব্যবস্থাপনায় গেলবছর যখন দেশটির অর্থনীতি একেবারে ভেঙ্গে পড়ে তখন থেকেই অনেক লেবানিজ নিজের দেশেই বাস্তুচ্যুত, সর্বহারা ও প্রান্তিক হয়ে পড়েন। এসময় তারা সরকারের নামমাত্র কিছু সেবা নিয়ে ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে দিন পার করছিলেন।

বিস্ফোরণের পর আগস্টের প্রথম সপ্তাহ থেকে হাজার হাজার মানুষ সরকারের প্রতি তাদের অনাস্থা ও ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকেন। সরকারের অক্ষমতা ও জনগণকে সেবা দেয়ার উদাসীনতায় বন্দরে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে বলে মনে করে নাগরিকরা। বিক্ষোভকারীদের প্রতীকী ফাঁসি প্রদর্শনই শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি চরম ঘৃণার জানান দেয়, যারা দীর্ঘদিন তাদের শাসন করেছে এবং পুরো অর্থনীতিকে ঋণে ডুবিয়ে দেউলিয়া করেছে। প্রতিবাদীদের আক্রমণ এবং মন্ত্রণালয় ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেয়া থেকে বোঝা যায়, তারা শাসন প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে চান। একই সঙ্গে তারা উদাসীন, দুর্বৃত্ত, লুটপাট মেনে নেয়া রাজনীতিবিদরা আবারো ক্ষমতায় আসুক তা একেবারেই চান না। বিক্ষোভের “অল মিনস অল” শ্লোগান আরো জোরালো হয়েছে এবং জনগণ সমস্ত রাজনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধেই তাদের ক্ষোভ তুলে ধরেছেন।

বিক্ষোভকারীরা সরকারের অংশীদার হিজবুল্লাহরও সমালোচনা করে। কেননা হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহও রাষ্ট্রপতি মাইকেল অনের সুরে সুর মিলিয়ে বন্দরের বিস্ফোরনের আন্তর্জাতিক তদন্তের প্রস্তাবকে নাকচ করেন এবং অন্যান্য নিন্দিত রাজনীতিকের মতই তিনি বলেন, তার দলও বন্দরে বিস্ফোরিত অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট মজুদের বিষয়ে কিছুই জানতো না। গত কয়েকদিনের ঘটনা শাসকগোষ্ঠীর নিকট অতীতের নিষ্ঠুরতায় পুঞ্জীভূত ক্ষোভের প্রকাশ মাত্র। এখান থেকেই জনগণ একটা নতুন শাসনব্যবস্থার পথ খুঁজতে চায়।

দেখা যাচ্ছে সরকার নিজেদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে হওয়া জনস্রোতকে সামরিক কায়দায় মোকাবিলা করছে। সম্প্রতি দেশটির জনগণ বিদেশী দাতাদের সবধরনের মানবিক সহায়তা সরকারের মাধ্যমে না দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে। কেননা তাদের আশঙ্কা এসব ত্রাণও তারা চুরি বা বিক্রি করে দিতে পারে। এমনি কেবল তাদের অনুগতদের মধ্যে বিতরণ করতে পারে। বিদ্রোহী জনগণ তাদের অনাস্থার বার্তা দেয়ার সাথে সাথে সরকারের মধ্যে ভাঙ্গন দেখা দেয়। ৯ আগস্টই জনতার দাবির মুখে বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্য এবং মন্ত্রী পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। তার একদিন পরই প্রধানমন্ত্রী হাসান দিয়াবের সাথে মন্ত্রীসভা ও সংসদের বাকি সদস্যরা পদত্যাগপত্র জমা দেন।

লেবাননের নাগরিকরাও ২০১০ সাল থেকে অন্যান্য আরব দেশের মত বহুমাত্রিক ঘটনার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। যারা কিনা চরম বঞ্চনা আর নির্যাতনের মুখে শাসকগোষ্ঠীকে ক্ষমতা থেকে নামাতে রাস্তায় তীব্র জনবিক্ষোভ গড়ে তুলেছিলো। সুদান, আলজেরিয়া, সিরিয়া, মিশর, ইরাক বা অন্যান্য দেশের মত লেবাবনের লাঞ্ছিত ও নিপীড়িত জনগণও সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। যাদের ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা কখনোই সহজ কাজ নয়। তবে লেবাননের ক্ষমতা কাঠামো অন্যান্য আরব দেশের থেকে আলাদা। তাই সরকারের পতন আন্দোলন করা এবং নতুন সরকার গঠন করা সহজ কাজ নয়। এমনকি সরকারের অনিয়ম মোকাবিলা করা আরো কঠিন। অন্যদিকে সংসদের প্রধান দল সুন্নি, বিভিন্ন মতের খৃস্টান, দ্রুজ এবং অন্যরাও সংকটকালে সমর্থন দিবে যদি সরকার ও আর্থিক কার্যক্রমে তাদেরও রাখা হয়!

গত বছরের ঘটনায় লেবাননের নাগরিকসহ দলের সমর্থক যাদের জীবনমান নিচে নেমে গেছে তাদের কাছে প্রধান দলগুলো নিন্দিত হয়। এ দলগুলো নিজেরা শাসন ব্যবস্থার কাঠামোগত পরিবর্তনে জনগণের দাবি মোকাবিলা করতে অপারগ। রাষ্ট্রপতি অনের ফ্রি প্যাট্রিওটিক মুভমেন্ট এবং সাদ হারিরির ফিউচার মুভমেন্ট কেবলমাত্র হিজবুল্লাহর সমর্থন নিয়ে শাসন ক্ষমতায় বসতে পারেন, যা গত কয়েক বছরে দেখা গেছে। হিজবুল্লাহ কিছুটা ভিন্ন ধরনের শক্তির জানান দেয়। এরা রাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর চেয়ে শক্তিশালী এবং অন্যান্য দলের চেয়ে বেশি সুসংহত। এছাড়া হিজবুল্লাহ ইরান, সিরিয়া এবং অন্যান্য আঞ্চলিক গোষ্ঠীর সাথেও সংযুক্ত। দেশটিতে যারাই ক্ষমতায় এসেছে হিজবুল্লাহ বিভিন্ন সময় শিয়া, সুন্নি, প্রধান খৃস্টানগোষ্ঠীকে সমর্থন দিয়ে পর্দার পেছন থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করেছে।

লেবাননে এখন হয়তো নতুন ধারার সূচনা হতে যাচ্ছে, যেখানে হিজবুল্লাহ ও সরকারবিরোধী অপ্রতিরোধ্য বিক্ষোভকারী (যারা বর্তমান শাসন কাঠামোর পরিবর্তে গণতান্ত্রিক এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চায়) এই দুই শক্তিশালী গ্রুপ এক হয়েছে।

যদি বিক্ষোভকারীরা তাদের প্রতি জনগণের বিপুল সমর্থনকে রাজনৈতিক পদ্ধতিতে কাজে লাগায়, তাহলে তারা দু’টি মূল দাবি জানাতে পারেন। এখনকার শীর্ষ ক্ষমতাধরদের বিতাড়িত করা আর নিরপেক্ষ ব্যবস্থাপকদের অধীনে নির্বাচন আয়োজন। আশা করি একটা অসাম্প্রদায়িক নির্বাচনী আইন প্রণয়নে কার্যকরভাবে সমঝোতা হবে। যা নতুন রাষ্ট্রপতি এবং সরকারের সম্পূর্ণ সংস্কার নিশ্চিতে নতুন নির্বাচনকে অনুমোদন দেবে। এই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য টেকনোক্র্যাট প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আয়োজন করবে, যারা মূলত সংখ্যাগরিষ্ঠ অভাবী জনগণের পাশে থেকে অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতেও কাজ করবে।

এখনকার অনেক নিন্দিত শীর্ষ রাজনীতিকই এর বিরোধিতা করবেন। কিন্তু হিজবুল্লাহ খুব সম্ভবত এটা মানবে না, যদি তা বিশেষ কিছু মানদণ্ড পূরণ না করে। এই গ্রুপটি (হিজবুল্লাহ) লেবাননকে ধ্বংস হতে দিতে চায় না আবার নিজেরাও সরাসরি লেবাননের শাসন ক্ষমতায় বসতে চায় না। তবে এটাও ঠিক এরা তাদের কাছে থাকা অস্ত্র ভাণ্ডার সমর্পণ করবে না, যা দিয়ে তারা ইসরাইলকে দুবার যুদ্ধবিরতিতে বাধ্য করেছিলো এবং লেবানন-ইসরাইল সীমান্তে প্রতিরোধ গড়তে সক্ষম হয়েছে।

সুতরাং বিদ্রোহী এবং লেবাননের নাগরিকদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হলো- হিজবুল্লাহ এবং নাগরিকরা কি একটি সমঝোতা চুক্তিতে আসতে পারবে কি না? যা একটি সত্যিকারের সক্ষম এবং দীর্ঘমেয়াদী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনে সহায়ক হবে। যে সরকার হিজবুল্লাহকে অস্ত্রবিরতিতে পাঠিয়ে আলোচনায় বসিয়ে দেশটির অর্থনীতি পুনরুদ্ধারেও কাজ শুরু করতে পারবে। হিজবুল্লাহর সশস্ত্র কার্যক্রম বন্ধ হওয়া বা চালু রাখার সম্ভাবনা নিয়ে অনেক নাগরিকের চিন্তা থাকলেও তা নিয়ে কোনো ঐক্যমতে পৌঁছানো যায়নি। একারণেই হিজবুল্লাহর সমর্থন নিয়ে বছরের পর বছর দুর্নীতিগ্রস্ত দেউলিয়া শাসনব্যবস্থা চলে এসেছে। যা দেশটিকে বিধ্বস্ত করে ফেলেছে।

হিজবুল্লাহ ও তাদের বাইরের সমর্থকদের সহায়তায় শাসকদের দীর্ঘদিনের এ দুর্বৃত্তায়ন আর সরকারের কর্মকর্তাদের অদক্ষতার শেষ দেখছেন সাধারণ নাগরিকরা। ক্ষণগণনার মুহূর্ত এসে গেছে। কেননা শীর্ষ রাজনীতিবিদদের জনগণের কাছ থেকে আর কিছুই লুট করার নেই। নাগরিকদের আর ধৈর্য নেই, তারা এখন দোষীদের বিচার চান। সেইসাথে চান হিজবুল্লাহ এমন একটি নতুন কৌশল নির্ধারণ করুক যা বিদ্রোহী নাগরিক এবং হিজবুল্লাহ উভয়ের স্বার্থ সংরক্ষণ করবে।

স্বত্ব: আল-জাজিরা, অনুবাদ: হরিপদ সাহা।

লেখন: রামি জি খওরি, গবেষক ও অ্যামেরিকান ইউনির্ভাসিটির সাংবাদিকতা বিভাগের প্রফেসর, বৈরুত।

Originally posted 2020-08-16 08:03:43.



Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked as *