বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ফোকলোর নিয়ে আলাপচারিতা

করোনার এই অবরুদ্ধ সময়ে ম্যাসেঞ্জারে হাই, হ্যালো, চলতে থাকে, কবি, কথাসাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের সাথে, যখন এই হাই-হ্যালো ছাড়িয়ে চ্যাটিং গড়িয়ে যায় বিভিন্ন চিন্তামূলক আলাপে, তখন সেই আলাপে বের হয়ে আসে অনেক যুক্তি, ও তথ‍্য, নিজস্ব মতামত সম্প্রতি কথাসাহিত্যিক মেহেদী উল্লাহ তাঁর ফেসবুক টাইমলাইনে এমনই চিন্তামূলক চ্যাটিং আয়োজন–‘হাফ এন আওয়ার চ্যাটিং এবাউট কালচার’ (Half an hour chatting about culture) নিয়ে কথা বলেছেন, কবি লেখক ও গবেষক নাজমীন মর্তুজা’র সাথে।

মেউ : ফোকলোর নিয়ে কাজ করার আগ্রহ তৈরি হলো কীভাবে? আপনি নিশ্চই ফিল্ডওয়ার্ক করেই কাজ করেছেন। বইপত্রের ধরন দেখে তাই মনে হয়।

নাজমীন মর্তুজা : ধন্যবাদ আপনাকে সুন্দর একটা প্রশ্ন করবার জন্য।
ফোকলোর নিয়ে কাজ করার আগ্রহ যদি বলি, সেটা কেমন করে, কিভাবে এলো আমি নিজেও জানিনা, অবচেতন মনে যেমন মানুষের অনেক কিছু ভালো লাগে ব্যাপারটা ঠিক তেমন, একজন মানুষ গান পাগল হলেও সব ধরনের গানে কিন্তু মজে যায় না, সেক্ষেত্রে দেখা যায়, কারও ফোক গান শুনলেই পাগল অবস্থা কারও বা খেয়াল ঠুমরী, কারও বা গজল, কিন্তু সার্বিক অর্থে গান পাগল, কিন্তু আগ্রহের বেলায় একটা দিক কে বেছে নেয়। তেমনি আমি লেখক আগে, তারপর ফোকলোর গবেষক, এই বিষয়টাতে আমি সহজেই যেমন মিশে গিয়ে সহজভাবে লিখতে, জানতে, ও বিশ্লেষণ করতে পারি, সেজন্যই এই বিষয়ের উপরেই আমার আগ্রহবেশী।
আর যে কাজ করলে প্রাণে শান্তি পাওয়া যায়, সে কাজের পানেই হয়ত মানুষ ছোট অহনিশি। আমিও তাই প্রাণের শান্তির তাগিদেই কাজগুলো করে যাচ্ছি। আনন্দ নিয়ে প্রশান্তি নিয়ে।
আমরা জানি যে বাংলাদেশের সংস্কৃতির ধারা তিনটি : নগরসংস্কৃতি, গ্রামসংস্কৃতি ও উপজাতীয় সংস্কৃতি, আর এই সংস্কৃতি গুলোর ঐতিহ্য, কর্ম, প্রচার, আনুষ্ঠানিকতা জানতে হলে একজন গবেষককে অবশ্যই মাঠ পর্যায়ে হাতে কলমে যেমন শিক্ষা নিতে হয়, তেমনি নিজ চোখে দেখে শুনে বিশ্লেষণ করলে, আপন কাজের ক্ষেত্রে ফাঁকির জায়গাটা কম থাকে, এবং কর্ম উদ্দিপনা বেড়ে যায় , জানার এবং শেখার, নতুন নতুন অভিজ্ঞতার সঞ্চার হয়, বিশ্লেষনের পরিধি বিস্তার করে।
একজন ফোক গবেষক মাঠ পর্যায়ে অনুপস্থিত থেকে লাইব্রেরী ওয়ার্ক করে আমার মনে হয় না ভালো কিছু করতে পারে। যত দেখা তত শেখা। সেক্ষেত্রে আমি আমার সাধ্যমতোই ক্ষেত্রসমীক্ষণের মাধ্যমে লেখার চেষ্টা করেছি।

মেউ : হ্যাঁ, আপনার লেখকসত্তা নিয়ে আমি জানি। আপনি যখন কাজ শুরু করেছিলেন, সেইসময়টায় ফোকলোর বলতে শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষয়টা পড়ানো হত, বাংলা একাডেমিতে কার্যক্রম চালু ছিল, আর পত্রপত্রিকায় মাঝেমধ্যে ফিচার ছাপা হত। বর্তমানে দেশের আরো তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সরাসরি ফোকলোর পড়ানো হয়, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয় ঐতিহ্য অধ্যয়ন, এই যে ফোকলোরের প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা, এর সম্ভাবনাকে কীভাবে ভাবেন? আপনার সময়টা কেমন ছিল?

নাজমীন মর্তুজা : জ্বি জ্বি .. আমি কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ এবং স্মৃতিকথার পাশাপাশি ফোকলোর গবেষণা করে যাচ্ছি। এখন ফোকলোরচর্চা তরান্বিত হচ্ছে। সমাজজীবনে আপন সংস্কৃতি, ঐতিহ্যকে সাথে নিয়ে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ ঘটাতে না পারলে জাতিগতভাবে পিছিয়ে পড়তে হয়। সেক্ষেত্রে আমরা নিজের সংস্কৃতিকে যদি না জানি, চর্চা না করি তাহলে জাতি হিসেবে উন্নয়ন সম্ভব না ৷ এতে দেশের সার্বিক উন্নয়ন হয় না! এখন গ্রামের মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে, শহরের সংস্কৃতি গ্রামের সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করছে। শহরের সংস্কৃতির প্রভাবে গ্রামের সমাজ-জীবনে গোষ্ঠীগত চিন্তার কাঠামো নতুনরূপে বিকশিত হচ্ছে। আগে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফোকলোর বিভাগ না থাকলেও ব্যক্তিগত পর্যায়ে ফোকলোর চর্চা হতো এবং নিজ উদ্যোগেই বই প্রকাশ করতো। সেসময় পত্রিকার ভিজুয়াল মিডিয়ার এতো সুযোগও ছিল না, তবুও আপনমনের টানে অনেকেই কাজ করেছেন । কিছু বই আকারে এসেছে বাদ বাকি নিজস্ব সংগ্রহশালার বাক্সে বন্দি। দেশে ফোকলোর নিয়ে পদ্ধতিগত গবেষণা ও চর্চার সুযোগ তৈরি হয় ১৯৯৮ সালে। সে বছরেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণাঙ্গভাবে ফোকলোর বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়েই ফোকলোর বিভাগ চালু করা উচিত। জাতীয় ফোকলোর ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা দরকার, যার অধীনে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রশিক্ষণকেন্দ্র গড়ে তোলা। গবেষকদের ফান্ড প্রদান করার ব্যবস্থা করা উচিত।
সে সময়টাতে শুধু বাংলা একাডেমির চৌহদ্দিতেই যতটুকু এবং বাইরের দেশের ফোকলোরবিদদের সাথে একটু আধটু দেখা পাবার সুযোগ ছিল। নিজ উদ্যোগেই গবেষণা কাজগুলো হতো। নিজ আগ্রহ ও অর্থখরচ করেই বেশির ভাগ কাজ করতো। গবেষণা প্রবন্ধগুলো পত্রপত্রিকায়ও তেমনটা ধারাবাহিক আসতো না, এখনকার মতো । এখনতো ভিজ্যুয়াল মিডিয়ার জন্য ফোকলোর চর্চা অনেকখানি এগিয়ে, বিশেষ করে পারফর্মিং ফোকলোর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাওয়া যাচ্ছে।

মেউ : ‘বাংলাদেশের ফোকলোর’ আপনার একটি বই। এই বইয়ে আপনি ফোকলোরের বিভিন্ন উপাদান নিয়ে বলেছেন। নারীর নির্মিত লোকসংস্কৃতির বিশ্লেষণ নিয়ে একটা অধ্যায় আছে এতে। নারী তার সৃষ্ট উপাদানসমূহে নিজেকে ছাড়া ‘পুরুষ’ বা অন্য লিঙ্গ নিয়ে নিয়ে কীভাবে ভাবে? তার উপস্থাপন কেমন? পুরুষের সাহায্যে আসলে নারী বনাম সোসাইটিতে তার প্রতি হেজিমনিটা বুঝতে চাচ্ছিলাম?

নাজমীন মর্তুজা : বইটিতে একটি অধ্যায় রেখেছিলাম ‘ফোকলোর: নারীকেন্দ্রিক সংস্কৃতি’, সেখানে নারীর কাঁথাশিল্প, মেয়েলীগীত, নারী কেন্দ্রিক উৎসব ও গণমাধ্যম এবং বিবাহের ঐতিহ্যিক পরিচয় নিয়ে আলোচনা ছিল। এসবে নারীর আত্মিক সম্পর্কের একটা যোগসূত্র আছে, সৃজনের সাথে নারীর ক্ষমতা, ধৈর্য, অধ্যাবসায়, যাপনের যুদ্ধ, স্বনির্ভরতা, স্বাধীনতা, একটা কাঁথার বুননের সাথে একজন নারীর জীবন-যুদ্ধের পাওয়া না পাওয়ার সময়গুলো সুতো দিয়ে নক্সায় আঁকে, তেমনি করে মেয়লী গীতগুলো নারীর অন্তর্গত আখ্যান কাব্য ,আমাদের পূরুষশাষিত সমাজে নারী কতটুকু স্বাধীন বা কতটুকু পরাধীন , নিজের ইচ্ছা ও আত্মত্যাগ কিংবা পাওয়ার স্বাদ, দৈনন্দিন জীবন যাপন, সম্পর্ক বিচ্ছেদ-বেদনার কথাগুলো আপন মহিমায় করুণ আবেগের সুরে রচনা করে গেছেন, তেমনি বিবাহ পরস্পর সম্পর্কিত নারী-পুরুষ যখন স্বামী-স্ত্রী হিসেবে চিহ্নিত হয়। তারপর দাম্পত্য এই যে সফর এটির সাথে নারীর নিধান কাল পর্যন্ত একটা অপার ক্ষমতা যাকে বলা হয় পর আপন করার প্রক্রিয়া এটা কোন মামুলি বিষয় নয়। বর্তমানে পুরুষশাষিত সমাজে নারীর অন্তর বেদনার জীবনচিত্র যথাযথভাবে এই বিষয়গুলোতেই পাওয়া যায়।
আমাদের বেশিরভাগ উৎসবগুলো হলো নারীকেন্দ্রিক, যেমন বিভিন্ন পূজা, দুর্গা, কালি, স্বরস্বতী এমন অনেক আছে, তাই হয়ত নারীকে মাতৃ-বিদ্যা-শক্তি-শান্তিরূপে প্রকাশ করা হয়। তবে নারীকেন্দ্রিক উৎসবগুলো নিয়ে গণমাধ্যমে তেমন করে উৎসবের অন্তর্গত প্রেরণার কথাগুলো ঠিকভাবে উচ্চারিত হয় না। বাইরের জাঁকজমকই বেশি দেখানো হয় । হতে পারে গণমাধ্যম কর্মীদের বিশদভাবে ইতিহাস পর্যবেক্ষণের তেমন করে টান থাকে না। এখানেও পুরুষশাষিত সমাজের একটা ছায়ার আড়ালে নারীর সমস্ত কেন্দ্রিকতার আলো ঢাকা পড়ে যায়।

মেউ : আমাদের এখানে যাঁরা সংস্কৃতি চর্চা করছেন, তাঁদের কেউ কেউ ‘ফোকলোর’ বা ‘লোকসংস্কৃতি’ হিসেবে এই শ্রেণির সংস্কৃতিকে দেখতে ইচ্ছুক না। তাদের আপত্তির কারণ, ‘লোক’ শব্দটির মধ্য দিয়ে এটাই বুঝানো হয়, এই গ্রুপ অব পিপল মেইনস্ট্রিম না৷ এই বির্তকে আপনার অবস্থান কী?

নাজমীন মর্তুজা : বহির্বিশ্বে ফোকলোরকে লোকগোষ্ঠির জ্ঞান ও জীবনাচরণের মূল হিসাবে দেখা হয় , কিন্তু আমাদের দেশেই কেবল এমন করে হেয় করে পেছনের দিকে ঠেলে দেয় মানুষ। ফোক নিয়ে কাজ করা ফোক গবেষকের প্রায় এমন শব্দ গুলো শুনতে হয়। যারা বলেন ফোক গবেষকরা মেইনস্ট্রিম না। তাদের জানার গণ্ডিটা খুব স্বল্প বলে আমি মনে করি। আমার অগ্রজদের শুনতে হয়েছে এমন কথা, সেখানে আমি তো ক্ষুদ্র মানুষ। সার্বিক অর্থে এসব সমালোচক আসলে “লোক“ অর্থে খুব অবহেলিত স্বশিক্ষায় শিক্ষিত মানুষদের জন্যই বলেন। কিন্তু তারা যে কতটা জ্ঞানের আধার, এই ফিল্ডে কাজ না করতে গেলে, বোঝা মুশকিলই বটে। গ্রামের বিশাল জনগোষ্ঠী নিজস্ব জীবনপ্রণালীর মাধ্যমে শতকের পর শতক ধরে যে বহুমুখী ও বিচিত্রধর্মী সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে, তা-ই বাংলার লোকসংস্কৃতি নামে অভিহিত।
আবার নগরের স্বল্প পরিসরে ঘন বসতিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর শিক্ষাদীক্ষা, ব্যবসায়, বৃত্তি, পোশাক-পরিচ্ছদ, আহার-বিহার, আনন্দোৎসব, যাতায়াত ও উৎপাদন পদ্ধতির সংমিশ্রণে নগরসংস্কৃতি গড়ে ওঠে। এই তো আমাদের দুটো সংস্কৃতি, এখানে শ্রেণিতে ফেলা না ফেলা অমূলক। নগর ও গ্রাম সংস্কৃতি নিয়েই আমরা ।

মেউ : অনেকে বলেন, এটাই আমাদের মূল সংস্কৃতি, বাঙালির শেকড়, কাজেই আলাদা করে ‘লোক’ বলার দরকার কী! সংস্কৃতি বললেই হয়! কারণ ‘শহুরে সংস্কৃতি’ বা ‘নগর সংস্কৃতি’র জন্য আলাদা করে বিশেষায়িত বিভাগ নেই ফোকলোরের মত! সেজন্য বলে কি? আপনি বললেন, গ্রাম আর শহরকেন্দিক দুধরনের সংস্কৃতি আছে। বুঝতে পেরেছি, সেটা মোটাদাগে। কিন্তু, জনপ্রিয় সংস্কৃতি, ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি, উত্তর-ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি, এসব সংস্কৃতির সঙ্গে গ্রাম ও শহুরে সংস্কৃতির পার্থক্য করতে পারি কীভাবে?

নাজমীন মর্তুজা : অবশ্যই নগর সংস্কৃতি ও গ্রাম সংস্কৃতির মধ্যে অনেক ব্যবধান আছে বলেই ধারা ভাগ করা হয়েছে । পৃথকীকরণ না করলে স্বকীয়তার ভেদ কি করে বোঝা যেত। লোকায়ত সমাজে বাসরত Mass people এর সৃষ্টিলব্ধ শৈল্পিক জ্ঞানই ফোকলোর। শহর বা নগর সংস্কৃতি তো একটাই। তবে সার্বিক অর্থে লোকসংস্কৃতির অজস্র উপাদানের রূপ-প্রকৃতির বিচার করে একে চারটি প্রধান ধারায় ভাগ করা হয়: বস্তুগত, মানসজাত, অনুষ্ঠানমূলক এবং প্রদর্শনমূলকে।
লোক সংস্কৃতির নগর সংস্কৃতি, যা গ্রহণ-বর্জনের মাধ্যমে পরিবর্তন ও রূপান্তর প্রক্রিয়ায় প্রতিনিয়ত বিস্তার ও উৎকর্ষ লাভ করে। কিন্তু গ্রামকেন্দ্রিক প্রকৃতিনির্ভর মানুষের জীবনযাত্রামূলত ঐতিহ্যমুখী, গতানুগতিক ও মন্থর। গ্রামে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ পায় না তেমনটা তাই তারা পূর্বপুরুষদের কাছ জীবন যাপন থেকে উৎপাদন, যানবাহন, যন্ত্রপাতি, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্য, বাসস্থান , ধর্মকর্ম, চিত্তবিনোদন ইত্যাদি সম্পর্কে প্রত্যক্ষভাবে অভিজ্ঞতা অর্জন করে। আর তাকে অবলম্বন করেই জীবনযাত্রা নির্বাহ করে। সরলতা, সজীবতা ও অকৃত্রিমতাই আমাদের লোকসংস্কৃতির মৌলিক বৈশিষ্ট্য।

মেউ : লোকসংস্কৃতি কি আসলেই ‘সরল’? কলিম খানের লোকছড়ার বিশ্লেষণ বা ফ্রয়েডীয় তত্ত্বে ব্যাখ্যা, রাশিয়ান মার্ক্সবাদী বিশ্লেষণ এসব দেখে ত মনে হয় না অন্তর্গত উপাদান সরল?

নাজমীন মর্তুজা : পৃথক পৃথক ব্যক্তি-বিশেষের সৃষ্টি পরিণত হয়েছে জনগোষ্ঠির ঐতিহ্যে যার মাধ্যমে প্রকাশ ঘটেছে ভালোবাসা, আবেগ, অনুভূতি ও চিন্তা চেতনার দর্শন, মতবাদ, সেক্ষেত্রে কলিম খানের লোকছড়ার বিশ্লেষণ বা ফ্রয়েডীয় তত্ত্বে ব্যাখ্যা, রাশিয়ান মার্ক্সবাদী বিশ্লেষণ এসব দেখে মনে হবার কোন কারণই নাই যে এসবের অন্তর্গত উপাদান সরল। তবে কিছু গবেষক বলেন যে, শিশুমানস’ই নাকি লোকসংস্কৃতির লীলাভূমি। তারমানে সরল, কিন্তু আমি সরল মনে করি না, অনেক সহজ সরল ভাষায় অনেক কঠিন ধাঁধা কিম্বা হেঁয়ালি যেমন আমরা পাই, তেমনি পাই লোক গণিতের হিসেবের জেরবার থেকে লোকছড়ায় জীবন দর্শন, আবার কিছু গানে… যেমন লালনের গান, সহজ ভাষায় লিখলেও যেন সহজ নয় তো বোঝা।

মেউ : আপনি ফিল্ডওয়ার্ক করেছেন, ভালো বুঝতে পারবেন। ফিল্ডওয়ার্ক এ গিয়ে একজন গবেষক কি নিজের রুচি, দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি আরোপ করেন লোকমানসে? যেহেতু ফোক এলিমেন্ট নিজেই বুঝে না তারা ফোক, তাদের হয়ে ব্যাখ্যাটা আমরা করছি!

নাজমীন মর্তুজা : সহজ মানুষকে পেতে হলে আগে চাই নিজ চিত্তকে পবিত্র করা, তারপর একাগ্রচিত্তে সেই সহজ মানুষকে সন্ধান করা। কিন্তু সন্ধান করলেই তাকে হাতের নাগালে পাওয়া এতো সহজ নয়। আমাদের সৃজনশীল মানুষগুলো সৃজনে মশগুল থাকে আপন মনের প্রশান্তির তাগিদে, সেক্ষেত্রে তারা প্রচার প্রসারের জায়গাটাকে মজবুত করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে না কখনোই, এমন কিছু মানুষ আছে যারা নিজেরাই কোনদিন চিন্তা করেনি তাদের রচিত গান একদিন মানুষের মুখে মুখে ফিরবে। যুগের পরিবর্তনের সাথে এসব সৃজনশীল মানুষ এখন অনেকটা এগিয়ে, তারা বোঝেন সংগ্রহকদের বা বোঝেন ইন্টারভিউ, বোঝেন গবেষণা কাজ, বোঝেন পেপার পত্রিকা, ভিজুয়াল মিডিয়ার ভাষাও। আবার অনেক গুণীজন আছেন কোনকিছুর মাঝে নেই, আপন ভুবনে তিনিই বাদশা। একজন গবেষককে মিশে যেতে হয় তাদের সাথে, আন্তরিক হয়ে তাদের মতো একজন হতে হয়, তবেই তারা মনের গোপন ভেদ খুলে দেয়, এবং আস্তে আস্তে তাদেরকে বোঝানো যায় কিভাবে লিখবে, কিভাবে বলবে… যা যা দরকার, বা তাকে নিয়ে কি কাজ হচ্ছে এবং গবেষকের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলে তাদের সহযোগীতা অনায়াসে পাওয়া যায়। গবেষকের নিজের রুচি দৃষ্টিভঙ্গি সহজেই আরোপ করা যায় না লোকমানসে। তবে সম্মান করাটা খুব গুরুত্বের বিষয়, এসকল মানুষ সম্মান চায়, আন্তরিকতা চায়। তাদের সাথে সহজে তরল হয়ে কাজ করলে ফলাফল ভালো হয়।

মেউ : সাইদুর রহমান বিয়াতি নিয়ে আপনি কাজ করেছেন। কন্টেন্টগুলো সুবিন্যস্ত! এমন কাজ সহজে হয় না। ওটা ছিল, সাধক নিয়ে আপনার সাধনা! আমার বিবেচনায়! সাইদুর বয়াতির পুথির মধ্যে সঞ্জীবনী শক্তি কী ছিল? আর তাঁর ভেষজ ওষুধ কি কি রোগ সারাতে পারে? কোভিড ১৯ এর উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসার কোন পথ্য আছে সেখানে?

নাজমীন মর্তুজা : বইটির নাম “সাইদুর রহমান বয়াতি সাধকের স্বদেশ ও সমগ্র”। এই বয়াতি একজন গুণী মানুষ, উনার প্রতিভা সম্পর্কে অবগত হই যখন উনাকে নিয়ে কাজ করতে গেছি তখন। এমন মানুষ নিয়ে কাজ করতে গেলে গবেষকের সুবিধে হয় বৈকী। একবাক্সে সব পাওয়া যায়। আমাদের দেশে এমন বহুগুণ সম্পন্ন মানুষ খুব কম জন্মেছে বলে আমি মনে করি। সাইদুর রহমান বয়াতির সবচাইতে যে কন্টেন্টটা ভালো লেগেছে এবং অনেক কিছু জানতে পেরেছি, সেটা সংগীত। যেখানে সৃষ্টিতত্ব, কামতত্ত্ব, প্রেমতত্ত্ব, ধুয়াগান, গুরুতত্ত্ব, ভক্তিতত্ত্ব, বৈষ্ণবতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, নারীতত্ত্ব, সাধনতত্ত্ব, সবকিছুর সাক্ষাত পেয়েছিলাম।
তাঁর ভেষজ ঔষধ আজকের দিনে কতটা কার্যকরী আমি সে বিষয়ে গলা উঁচু করে বলতে পারবো না, তবে হারবাল পদ্ধতির ঔষধ কিন্তু এখোনো ততটাই সমাদৃত আমাদের কাছে, তবে সব মেডিসিন কার্যকর তো নয় বটে, আবার কিছু কিছু মেডিসিনের তুলনা করা যায় না । সাধারণ অনেক রোগের চিকিৎসা তো আছেই সারাতেও পারেন, মাছের কাঁটা ফুটলে উনি যে মেডিসিন দেন সেটা খুব কার্যকরী।
কোভিডের ঔষধ এখন পর্যন্ত কিছুই বের হয়নি, সবই আন্দাজে ঢিল মারছেন, কিন্তু একটা জিনিস খেয়াল করবেন, ভেষজ কিছু যেমন কালোজিরে, মধু , আদা, লং, লেবুর রস, চ্যাবন প্রাস, দারুচিনি, কমলার খোসার গুড়ো খেতে বলছেন, এসব ভেষজের কোন সাইড ইফেক্ট নেই, তো এসব খেয়ে অনেকেই কোভিড মুক্ত হয়েছেন বলে নিউজ শুনি। যদি তাই হয়, তবে তো উনার ভেষজ মেডিসিন কার্যকরীই বলতে হবে।

মেউ : তুলনামূলক ফোকলোর আলোচনায় এই প্রসঙ্গটি প্রায়ই উঠে, আমাদের দেশের ফোকলোর চর্চার সঙ্গে অন্যান্য দেশের ফোকলোর চর্চার পার্থক্য কী? এবিষয়ে আপনার অভিজ্ঞতা শুনতে চাই?

নাজমীন মর্তুজা : বাইরের দেশে এসে ফোকলোর নিয়ে কাজ করতে গিয়ে লক্ষ্য করেছি, এদের দেশের পঠন – পাঠন , আলোচনা, সংগ্রহ, বিশ্লেষণের মাঝে একটা অভিনবত্ব আছে। বিশাল একটা সময় নিয়ে কি কাজ করে। সেই কাজের উপরে আগে পড়ে, বই সংগ্রহ করে এক্সপার্টদের সাথে আলোচনা করে এই বিষয়ে, তারপর গ্রুপ আলোচনায় যোগ দেয়, বিভিন্ন ওয়ার্কসপ এটেন্ড করে, তারপর মাঠ পর্যায়ে যায়। হুট করে ব্যাগপ্যাক নিয়ে ক্ষেত্রসমীক্ষায় বের হয় না।
মহাদেশীয় লোককথার তুলনামূলক বিচার ও বিশ্লেষণ নিয়ে তেমনভাবে আমাদের দেশে ওয়ার্কশপ হয়না, এই নিয়ে গবেষকদের মাঝে তেমন একটা আগ্রহ দেখা যায় না। বেশির ভাগ গবেষনা কাজগুলো শুধু লোকগান সংগ্রহ করা, লোকমানসের ইন্টারভিউ করা, সম্পাদনা করা। বাংলার সেই সব ঠাকুরমার ঝুলি, টুনটুনির বইসহ পঞ্চতন্ত্র, বেতালপঞ্চবিংশতি ও অন্যান্য ভারতীয় লোককথার সাথে নতুন করে বিপুল পরিমাণে ততো কাজ হয়নি যা বিশ্বফোকলোরে স্থান করে নিয়েছে। আমি নিজেও একটা কাজ করেছিলাম “ফোকলোর ও লিখিত সাহিত্য জারিগানের আসরে বিষাদ-সিন্ধু আত্তীকরণ ও পরিবেশন পদ্ধতি ।আমাদের দেশে গবেষণা ফান্ড নেই, গবেষকদের নিজ গরজে নিজের পয়সা খরচা করতে হয় বলে এমন দীর্ঘ সময়ের কাজগুলো ইদানিং এড়িয়ে যায় মানুষ। তারপর প্রকাশনাসংক্রান্ত জটিলতা তো রয়েছেই।

মেউ : লোকসংস্কৃতি বিষয়ক কী ধরনের বইপত্র পড়েন বা পড়েছেন?

নাজমীন মর্তুজা : বাংলা একাডেমির লাইব্রেরির অনেক ফোকলোর বিষয়ের বই পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম দেশে থাকা অবস্থায়, যেহেতু গবেষনার কাজে এসেছি অস্ট্রেলিয়ায়, তাই উনাদের গবেষণা বইয়ের পাতা বেয়েই প্রথম তথ্য সংগ্রহ করতে হয়েছিল, আস্তে আস্তে নতুনদের বই পড়তে শুরু করেছি, যেমন- সাইমন জাকারিয়া, সুমনকুমার দাশসহ অনেকের বই তথ্য নির্ভর। গবেষণায় কাজে লাগে বেশ। ইদানিং যাদের বই পড়ছি – বাংলার বাউল ফকির – জুলফিকার লিটন, বাংলাদেশের গবেষণা সাহিত্য – ডা: সেলুবাসিত, বাংলাদেশের সাহিত্য গবেষণা ও অনান্য – ভীষ্মদেব চৌধুরী, বেদে জনগোষ্ঠির জীবন – রণ্জনা বিশ্বাস, ফোকলোর রচনা পন্জি – মোহাম্মদ সুলতান মাহমুদ, তুলনামূলক ফোকলোর – রওশন জাহিদ, এমন অনেকের বই পড়ছি ।

মেউ : বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক সংকটগুলো এই মুহূর্তে কি কি? আর্থ-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট গত একযুগে কী রূপে বদলেছে? কোনদিকে যাচ্ছে বাংলাদেশ?

নাজমীন মর্তুজা : একুশ শতকে বাংলাদেশের সংস্কৃতির বিষয়গত রূপের পরিধি অনেক সুসম্প্রসারিত হওয়ার কারণে, সমাজ মানববিদ্যার বিষয়গুলোর লোকসাহিত্য বস্তু এবং অবস্তুধর্মী উপাদান, আচার কেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক উপকরণাদি মানস-বস্তুজাত পরিবেশনা প্রায়োগিত উপাদান এখন আমাদের সংস্কৃতির আলোচ্য বিষয় বটে । বাংলাদেশ পৃথিবীর সমৃদ্ধ সংস্কৃতির ধারণকারী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সমাজের চলমান সংস্কৃতির বিশ্ববোধ, ধর্ম, আচার-অনুষ্ঠান, বিশ্বাস ও নানা ক্রিয়াকলাপে, দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ধরন, উৎসব—সবকিছু মিলিয়েই একটা আর্থসামাজিক আমূল পরিবর্তন আসে। সেক্ষেত্রে অবশ্যই একযুগে আমাদের সংস্কৃতির রূপের বদল হয়েছে। পয়লা বৈশাখ এলে বাঙালির সংস্কৃতির নদীতে যেমন জোয়ার আসে, তেমনি বাধাও আসে। এখন আর তা জাঁকজমকে পালনের সুযোগ নেই, নানাভাবে ব্যহত করার জন্য লেগে যায়, রুখতে হবে শ্লোগান দিয়ে। নানা সংকট আমাদের আছে।

মেউ : আপু, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে সময় দেওয়ার জন্য, অনেক কষ্ট করলেন। ভালো থাকবেন।

নাজমীন মর্তুজা : আপনাকেও ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।


আলাপচারিতায়

মেহেদী উল্লাহ
কথাসাহিত্যিক
বর্তমানে জাতীয় কবি কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ফোকলোর বিভাগে শিক্ষকতা করছেন।

নাজমীন মর্তুজা
কবি, লেখক, গবেষক
বর্তমানে তিনি স্বপরিবারে সাউথ অস্ট্রেলিয়াতে বসবাস করছেন।