বন্যা-ভাঙ্গনে দিশেহারা পানিবন্দী মানুষ

পাহাড়ী ঢলে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৮০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে জেলার ৪৫টি ইউনিয়নের সাড়ে তিন লাখেরও বেশি মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি, শুকনো খাবারের সংকট।

পানিবন্দী মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে পানিবাহিত ডায়রিয়া, আমাশয় ও হাত-পায়ে ঘাসহ নানা রোগ। অন্যদিকে পানি বাড়ায় যমুনার অরক্ষিত অঞ্চলে দেখা দিয়েছে ভাঙ্গন। নিঃস্ব হয়ে পড়ছে মানুষ। সব মিলিয়ে যমুনা পাড়ের বন্যা-তীর ভাঙ্গন ও ভোগান্তিতে দিশেহারা হয়ে পড়েছে যমুনাপাড়ের মানুষ।

জানা যায়, দ্বিতীয় দফা যমুনার পানি বিপদসীমার ১০০ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হবার পর কমে ৬১ সেমি উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এরপর গত তিনদিন ধরে আবার বাড়তে শুরু করেছে।

শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত ৮০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। পানি বাড়ার কারণে দীর্ঘ প্রায় একমাস যাবত জেলার প্রায় সাড়ে তিন লাখেরও বেশি মানুষ পানিবন্দী রয়েছে। দীর্ঘসময় পানি থাকায় কৃষকের ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। রাস্তা-ঘাট তলিয়ে নষ্ট হয়ে পড়েছে। চরাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারো নাজুক হয়ে পড়েছে।

কলার ভেলা ও নৌকাই তাদের ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু সবার ঘরে নৌকা না থাকায় দিনরাত ঘরবন্দী হয়ে থাকছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বসতবাড়ীর বেড়াসহ আসবাবপত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। কাজকর্মহীন পানিবন্দী এসব মানুষ ভয়াবহ কস্টে দিনযাপন করছে। পানিবন্দী মানুষের ঘরে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। পানিবাহিত রোগ দেখা দেয়ায় ওষুধের সংকটে পড়েছে। সরকারীভাবে তেমন সহযোগিতা এখনো পানিবন্দী মানুষের ঘরে পৌছেনি। এ নিয়ে বন্যাকবলিতদের মধ্যে চরম হতাশা বিরাজ করছে।

অন্যদিকে, পানিবাড়ায় যমুনার অরক্ষিত অঞ্চলে তীব্র ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। গতকাল বিকেলে পাচঠাকুরী এলাকায় আকস্মিক ভাঙ্গনে বেশ কয়েকটি বসতভিটা নদীগর্ভে চলে যায়।

চরমিরপুর এলাকার আছিয়া খাতুন ও রুমি খাতুন জানান, প্রায় ২৫দিন যাবত পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছি। টিউবওয়েল, বাথরুম তলিয়ে গেছে। বহুকস্টে দিনযাপন করছি। আয় রোজগার নেই। এতো কষ্টে থাকলেও কেউ আমাদের খোঁজ নেয় না। ঋণদার করে খেয়ে না খেয়ে দিনযাপন করছি।

সিরাজগঞ্জে নিমিষেই শতাধিক বসতভিটা নদীগর্ভে বিলীন : যমুনা নদীর সদর উপজেলা পাঁচঠাকুরী এলাকায় প্রবল স্রোতে স্পার ভেঙ্গে নিমিষেই প্রায় শতাধিক বসতবাড়ী নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। আর ভাঙ্গন হুমকিতে পড়ে আশপাশের কয়েকটি গ্রাম। শুক্রবার দুপুরের দিকে যমুনার প্রবলস্রোতের কারণে হঠাৎ এ ভাঙ্গন দেখা দেয়।

ছোনগাছা ইউপি চেয়ারম্যান শহিদুল আলম জানান, দুপুরের দিকে হঠাৎ ভাঙ্গন শুরু হয়। নিমিষের মধ্যেই প্রায় শতাধিক বাড়ীঘর ও মসজিদ-গাছপালা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। এরকম ভাঙ্গন আগে দেখিনি বলেও তিনি জানান। তিনি জানান ভাঙন কবলিত বাড়ি-ঘরের মানুষগুলো জীবন বাঁচাতে আসবাবপত্র-ঘরবাড়ি ও গবাদিপশু ফেলেই নিরাপদ আশয়ে চলে আসেন। মুহুর্তেও নদী ভাঙনের কারণে শতশত মানুষ গৃহহীন ও নিঃস্ব হয়ে গেল। ভাঙন হুমকিতে রয়েছে আশপাশের কয়েকটি গ্রাম।

সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সরকার অসীম জানান, ক্ষতিগ্রস্তদের আপাতত বিভিন্ন স্কুল ও মাদ্রাসায় আশ্রয় দেয়া হচ্ছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের সার্বিক সহায়তা দেয়া হবে।

সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম জানান, এর আগে সিমলা স্পারের স্যাংক বাঁধের ৭০ মিটার অংশ ভেঙ্গে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর যমুনার পানি ঘুর্নিপাক খেয়ে সরাসরি বাঁধে আঘাত হানে। এ কারণে হঠাৎই ভাঙন শুরু হয়েছে। ভাঙন ঠেকাতে জরুরি ভিত্তিতে বালু ভর্তি জিওব্যাগ ডাম্পিংয়ের কাজ শুরু করা হবে। তবে পাউবোর অনেক কর্মকর্তারা করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় তড়িঘরি কাজ করতে সমস্যা হচ্ছে।

কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি : ড়িগ্রামের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। টানা বন্যায় প্রকট হয়ে উঠেছে খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি, গবাদি পশুর খাদ্য এবং স্যানিটেশন সমস্যা।

শনিবার ধরলা নদীর পানি ব্রিজ পয়েন্টে বিপদ সীমার ৬৫ সেন্টিমিটার এবং ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারী পয়েন্টে বিপদ সীমার ৭৭ সেন্টিমিটার ও নুনখাওয়া পয়েন্টে বিপদ সীমার ৬৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

বন্যা অব্যাহত থাকায় জেলার ৫৬ ইউনিয়নের ছয় শতাধিক গ্রামের প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ পানিবন্দী রয়েছে। খবর ইউএনবির।

গত ২৪ ঘণ্টায় নদী ভাঙনের শিকার হয়ে সারডোব, সাহেবের আলগা, থেতরাইসহ বিভিন্ন এলাকায় গৃহহীন হয়েছে আরও শতাধিক পরিবার। অনেকেই বাঁধে আশ্রয় নিয়ে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

কুড়িগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মো. হাবিবুর রহমান জানান, বন্যা কবলিতদের স্বাস্থ্যসেবার জন্য ৮৫টি মেডিকেল টিম কাজ করছে। তবে মেডিকেল টিমের কোনো সদস্যকে না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে বানভাসীদের।

উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের বতুয়াতুলির চরের মুসা মিয়া বলেন, ‘বন্যা এত দীর্ঘ হবে সেটা কেউই ভাবতে পারেনি। কাজকর্ম নেই, ঘরে খাবার নেই। পরিবার নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছি। ত্রাণ না পেলে আর বাঁচার উপায় থাকবে না।’

জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম জানান, জেলার প্রধান তিনটি নদীর পানি বিপদ সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে দেখা দিয়েছে ভাঙন। এ পর্যন্ত ৩১ কিলোমিটার বাঁধ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাঁধ ও স্পার রক্ষায় ১৯টি পয়েন্টে ভাঙন রোধে কাজ চলছে।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাস কর্মকর্তা আব্দুল হাই সরকার জানান, দ্বিতীয় দফা বন্যায় এ পর্যন্ত ১৯০ মেট্রিক টন চাল, ৯ লাখ টাকা ও ৬ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে।

ঈদের আগেই বন্যা কবলিত সোয়া চার লাখ মানুষের হাতে ভিজিএফ’র ১০ কেজি করে চাল পৌঁছে দেয়া হবে বলে জানান তিনি।

৫ জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে : কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, সিলেট, সুনামগঞ্জ এবং নেত্রকোণা জেলার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে।

সারা দেশে পর্যবেক্ষণাধীন ১০১ টি পানি সমতল স্টেশনের মধ্যে বৃদ্ধি পেয়েছে ৭২ টির, হ্রাস পেয়েছে ২৮ টির, অপরিবর্তিত রয়েছে ১ টির, বন্যা আক্রান্ত জেলার সংখ্যা ১৭ টি, বিপদসীমার উপরে নদীর সংখ্যা ১৯ এবং বিপদসীমার উপরে স্টেশনের সংখ্যা ৩০ টি।

আগামী ২৪ ঘন্টায় তিস্তা নদী ডালিয়া পয়েন্টে এবং বালু নদীর ডেমরা পয়েন্টে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। আগামী ২৪ ঘন্টায় বগুড়া, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, নাটোর, মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, রাজবাড়ি, শরিয়তপুর ও ঢাকা জেলার নিম্নঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির আগামী ২৪ ঘন্টায় স্থিতিশীল থাকতে পারে।

এছাড়া ঢাকা জেলার আশেপাশের নদীসমূহের পানি সমতল বৃদ্ধি আগামী ২৪ ঘন্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।

অন্যদিকে, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা আগামী ৪৮ ঘন্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। যমুনা নদীর পানি সমতল স্থিতিশীল আছে যা আগামী ২৪ ঘন্টায় বৃদ্ধি পেতে পারে।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, গঙ্গাপদ্মা নদীসমূহের পানি সমতল স্থিতিশীল আছে যা,আগামী ৪৮ ঘন্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আপার মেঘনা অববাহিকার প্রধান নদীসমূহের পানি সমতল বৃদ্ধি পেতে পারে।। যা আগামী ২৪ ঘন্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।

গত ২৪ ঘন্টায় সারাদেশে লরেরগড় ২৪২ মিলিমিটার, মহেশখোলা ২৪০ মিলিমিটার, কক্সবাজার ১৩৯ মিলিমিটার, লালাখাল ১৩৭ মিলিমিটার, ভাগ্যকূল ১৩৩ মিলিমিটার, সুনামগঞ্জ ১২০ মিলিমিটার
বৃষ্টিপাত হয়েছে।

বন্যার অবনতি উত্তরাঞ্চলে, পূর্বাঞ্চলে উন্নতি : আগামী ২৪ ঘণ্টায় সিলেট, সুনামগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও নেত্রকোনা জেলার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, চাঁদপুর, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর ও ঢাকা জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকতে পারে। অপরদিকে কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নাটোর, বগুড়া, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও নওগাঁ জেলার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে।

শুক্রবার (২৪ জুলাই) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র এসব তথ্য জানিয়েছে। তারা বলছে, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় পদ্মার পানি বৃদ্ধি পেতে পারে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের উজান মেঘনা অববাহিকার প্রধান নদীগুলোর পানি কমছে, যা আগামী ৪৮ ঘন্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। ঢাকা জেলার আশপাশের নদীগুলোর পানি বাড়ছে, যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।

বর্তমানে পর্যবেক্ষণাধীন ১০১টি পানি স্টেশনের মধ্যে বাড়ছে ৪৯টির, কমছে ৪৯টির এবং স্থিতিশীল রয়েছে ৩টির। বন্যা আক্রান্ত জেলা ২০টি। বিপৎসীমার ওপর দিয়ে ১৯টি নদীর পানি প্রবাহিত হচ্ছে। আর বিপৎসীমার ওপরে পানি প্রবাহিত হওয়া স্টেশনের সংখ্যা ৩০টি।

এদিকে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা কমেছে। বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা থেকে শুক্রবার সকাল ৯টা পর্যন্ত সময়ে উল্লেখযোগ্য বৃষ্টি হয়েছে নোয়াখালীতে ৭৬, কক্সবাজারে ৬৫ ও বরগুনায় ৫২ মিলিমিটার। একই সময়ে বাংলাদেশ সংলগ্ন ভারতের দার্জিলিংয়ে ৬৪ ও চেরাপুঞ্জিতে ৫২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।

Originally posted 2020-07-25 19:16:39.



Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked as *