বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সব তথ্য-উপাত্ত যেভাবে সংগ্রহ করা হয়

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যার পর এই নির্মম হত্যাযজ্ঞের বিচার বন্ধে সব ধরনের পদক্ষেপ নেয় পরবর্তী সরকারগুলো। এজন্য বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে গিয়ে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে ‍পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) বিশেষ পুলিশ সুপার ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আবদুল কাহার আকন্দকে।

তবে সবকিছু অতিক্রম করে তিনি ও তার তদন্ত দল সেনাবাহিনী, পুলিশ ও সরকারের বিভিন্ন দফতর ছাড়াও বিভিন্ন মাধ্যম থেকে মামলার প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে চার্জশিট দিতে সক্ষম হন।

ঘটনার দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচারের দ্বার উন্মুক্ত হয়। ওই বছরের ১৪ নভেম্বর জাতীয় সংসদে ইনডেমনিটি আইন বাতিল করা হয়। এর দেড় মাস আগে ওই বছরের (১৯৯৬) ২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাড়ির কেয়ারটেকার ও পিএ আ ফ ম মহিতুল ইসলাম বাদী হয়ে রাজধানীর ধানমন্ডি থানায় হত্যা মামলা [নং-১০ (১০) ৯৬] দায়ের করেন। এরপরই মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পান সিআইডির এএসপি আবদুল কাহার আকন্দ। বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা মামলাটির তদন্ত করতে গিয়ে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে তাকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে হয়।

তদন্ত কর্মকর্তা যা বললেন:

আবদুল কাহার আকন্দ বলেন, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তখন মামলা কিংবা জিডি কোনোটাই দায়ের করা সম্ভব হয়নি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ওই বছরের অক্টোবরে বঙ্গবন্ধুর পিএ আ ফ ম মহিতুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। তিনি যা দেখেছিলেন সেই অনুযায়ী একটি বিস্তারিত এজাহার দায়ের করেন। এজাহারে তিনি যা লিখেছিলেন সেটার ভিত্তিতেই তদন্ত শুরু করা হয়। তখন যেখানে যা যা নথিপত্র পাওয়া গেছে সেগুলো সংগ্রহ করি আমরা। বিভিন্ন জায়গা থেকে সেগুলো খুঁজে খুঁজে বের করা হয়েছে। কিছু জিনিস হয়তো ধ্বংস হয়ে গেছে। তারপরও হত্যাকাণ্ডের পর থেকে মামলা দায়ের পর্যন্ত আমরা যদ্দূর পেরেছি সেগুলো সংগ্রহ করেছি।’

আবদুল কাহার আকন্দ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর যারা ক্ষমতায় ছিলেন, তারা তো বিভিন্নভাবে যতটুকু পেরেছে এ হত্যাকাণ্ডের আলামত ধ্বংস করার জন্য চেষ্টা করেছে। পরে আমরা সেসব থেকেই যা পেরেছি উদ্ধার করেছি। যারা তখন কর্মরত ছিলেন তাদের খুঁজে বের করেছি। সেনাবাহিনী থেকে নথি উদ্ধার করেছি। আরও বিভিন্ন জায়গা থেকে আমরা নথিপত্র উদ্ধার করেছি। তারপর তদন্ত শেষ করে ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি ২০ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন টেলিভিশনে দেওয়া সাক্ষাৎকারের ভিডিওসহ ৪৬ ধরনের আলামত চার্জশিটের সঙ্গে আদালতে জমা দেওয়া হয়। তদন্তে নাম আসলেও চার্জশিটের আগে মারা যাওয়ায় সাবেক রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদসহ কয়েকজনের নাম চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। একই বছরের ১২ মার্চ (১৯৯৭) কয়েকজন আসামির উপস্থিতিতে আদালতে বিচার শুরু হয়।’

মামলার তথ্য:

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার নথিপত্রের তথ্য অনুযায়ী, বিচার প্রক্রিয়া শুরুর পর ১৯৯৭ সালের ১৯ জুন পর্যন্ত বিচারক বিব্রত হওয়াসহ নানা কারণে আটবার বিচার কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া শেষে ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। এ মামলার বিচারক কাজী গোলাম রসুল সাবেক ১৫ সেনা কর্মকর্তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন। নিম্ন আদালতে মামলাটির বিচার প্রক্রিয়া শেষে ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য হাইকোর্টে পাঠানো হয়। ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট বেঞ্চের বিচারপতি এম রুহুল আমিন ও এ বি এম খায়রুল হক বিভক্ত রায় দেন। বিচারপতি এম রুহুল আমিন ১৫ আসামির মধ্যে ১০ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। অন্যদিকে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ১৫ আসামিরই মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। পরে এ মামলার নথি হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চে পাঠানো হয়। সেই তৃতীয় বেঞ্চের বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম ২০০৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখেন। বাকি তিন জনকে খালাস দেন তিনি।

আবদুল কাহার আরও যা বললেন :

মামলাটিকে যিনি বিচারের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন সেই তদন্ত কর্মকর্তা আবদুল কাহার আকন্দ আরও বলেন, ‘মামলাটির এ পর্যায়ে সরকারের পরিবর্তন হয়ে যায়। তখন রায়গুলো বাস্তবায়নে দেরি হয়ে যায়। আবার যখন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে তখন হাইকোর্ট, সুপ্রিমকোর্টে মামলার বাকি কার্যক্রম শেষ করা সম্ভব হয়।

এ বিষয়ে নিজের অনুভুতির কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু দেশটা স্বাধীন করেছেন। যার কারণে আমরা দেশটা পেয়েছি। যিনি এ দেশে তার শত্রু আছে বলে মনে করতেন না। তেমন একটা লোক দেশের মানুষকে ভালোবেসে এত কিছু করেছেন। তাকে হত্যা করা জাতির জন্য দুর্ভাগ্য। এতে আমরা অনেক পিছিয়ে গেছি। তিনি বিশ্বাস করতেন এদেশের মানুষ তাকে মারবে না। কিন্তু সবাই তো আর বিশ্বাস রক্ষা করেনি। যাই হোক যারা হত্যা করল তারা সাধারণভাবে এ ঘটনা ঘটিয়ে ফেলল। অন্যান্য আরও যারা ছিল তারা কিছু টের পেল না। অনেক রহস্যজনক বিষয় আছে এসবের পেছনে। যারা টের পেয়েছে তারা যথাযথ ব্যবস্থা নেয়নি। তাদের মধ্যে অর্থাৎ আর্মির মধ্যে যে নেতৃত্ব ছিল সেটাতেও গলদ ছিল। যার জন্য এ ঘটনা ঘটানো সম্ভব হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘২১ বছর পরে আমরা ঘটনাটা তদন্ত করে মোটামুটি যারা সরাসরি জড়িত তাদের বিচারের সম্মুখীন করতে পেরেছি। তাদের সাজা হয়েছে। ইতোমধ্যে তাদের অনেকের ফাঁসি কার্যকরও হয়েছে। সেই হিসেবে এ জাতি দায়মুক্ত হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে তাই নিজেকে সফল মনে করি।’

যাদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে:

২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনি সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, বজলুল হুদা, মহিউদ্দিন আহমেদ ও একেএম মহিউদ্দিন আহমেদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। গত ১২ এপ্রিল (২০২০) ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এর আগে ৬ এপ্রিল (২০২০) মধ্যরাতে রাজধানীর মিরপুর এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয় বলে জানায় কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)।

বর্তমানে পলাতক যারা:

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামিদের মধ্যে রয়েছেন– আবদুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, নূর চৌধুরী, মোসলেম উদ্দিন ও রাশেদ চৌধুরী। তারা বিভিন্ন দেশে পালিয়ে আছেন। তাদের গ্রেফতারে ইন্টারপোলের পরোয়ানা রয়েছে। দণ্ডিত অপর আসামি আবদুল আজিজ পাশা পলাতক অবস্থায় জিম্বাবুয়েতে মারা গেছেন। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে রাশেদ চৌধুরীকে ফেরাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে চিঠি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

Originally posted 2020-08-16 08:12:19.



Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked as *