নিম্ন আয়ের মানুষের বাড়ছে হাহাকার

রাজধানীর খিলগাঁও এলাকার রোজিনা। মানুষের বাসায় কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। শিশু সন্তানও রয়েছে তার। বছর খানেক আগে স্বামী তালাক দেওয়ায় এখন নিজেই উপার্জন করেন। কিন্তু লকডাউনের কারণে বর্তমানে কাজও কমে গেছে। সামনে আসছে আরো কঠোর লকডাউন। তাই থাকা ও খাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে রোজিনার। ময়মনসিংহের ত্রিশালে বাড়ি রোজিনা জানান, কোনো আয় নেই। জীবন চলছে অন্যের দয়ায়। কেউ দিলে খাবার জোটে, না দিলে জোটে না। এভাবেই অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটছে।

শুধু রোজিনাই নন, বর্তমান করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে দিন যত গড়াচ্ছে, রাজধানীজুড়ে থাকা এসব মানুষের হাহাকার ততই বাড়ছে। লকডাউনের কারণে ফের বিপাকে পড়তে যাচ্ছে দেশের নিম্ন আয়ের মানুষ। বিশেষ করে শহরে বসবাসরত দিনমজুর ও নিম্ন আয়ের মানুষদের মাঝে রোজগার নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। তারা আশঙ্কা করছেন লকডাউনের সময় বাড়লে তাদের দুর্দশা আরো বেড়ে যাবে। এমন পরিস্থিতিতে অনেকেই শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যাচ্ছেন। আবার যারা শহরে থেকে যাচ্ছেন তারাও অনিশ্চয়তার প্রহর কাটাচ্ছেন।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে নিম্ন আয়ের মানুষদের সাথে কথা বললে এমন হতাশার চিত্র উঠে আসে। রাজধানীর রামপুরা-বনশ্রী এলাকায় ঘুরে ঘুরে চা বিক্রি করেন আফজাল হোসেন। করোনার আগে যা আয়-রোজগার হতো তাতে ভালোভাবেই চলত তার সংসার। কিন্তু করোনায় রোজগার বন্ধ হয়ে যায়। করোনায় প্রথম লকডাউনে চরম দুর্দশার পর পরবর্তীতে আবারো রোজগার শুরু করেন। রোববার সকালেও চা বিক্রি করছিলেন তিনি।

লকডাউনের কথা বললে আফজাল বলেন, ‘আগেরবার কোনোমতে দিন পার করছি। এবার আর উপায় নাই। তাই বিকালে ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়ি চলে যাব।’ তিনি আরো বলেন, ‘লকডাউন বাড়লে ঢাকায় না খাইয়া থাকা লাগব।’

আফজাল হোসেনের মতো একই অবস্থার কথা জানান রিকশাচালক জুম্মন। চাঁদপুর থেকে এসে রামপুরা এলাকায় রিকশা চালান তিনি। গ্রামের বাড়িতে স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে তার। রোজগার বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় ঢাকা ছেড়ে দেওয়ার কথা জানিয়েছেন এই রিকশাচালক।

এদিকে ঢাকাসহ সারা দেশে পরিবহন খাতে যারা বাস, মিনিবাসের ড্রাইভার, সুপারভাইজার বা হেলপার হিসেবে কাজ করেন তারা মজুরি পান প্রতিদিনের ট্রিপ বা যাতায়তের ওপর। ইতিমধ্যেই যাত্রী ও যাতায়াত দুটিই কমে যাওয়ায় তাদের আয় অনেক কমে গেছে।

দ্বিতীয় দফায় লকডাউনে গণপরিবহন বন্ধ হয়ে গেলে মালিকরা তাদের কোনো মজুরি দেবে কি না তা নিয়ে রয়েছে অনিশ্চয়তা। এ ছাড়া অটোরিকশা ও রাইড শেয়ারিংয়ে যারা কাজ করেন তারাও চিন্তিত।

বিশ্বব্যাংকের হিসাবে দেশে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেন। যারা দিন আনে দিন খায়। তার ওপর রয়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষেরা। করোনায় শুধু তারাই নন, যারা চাকরিজীবী নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত সবাই সংকটে আছেন। দ্বিতীয় দফায় লকডাউনে সেই সংকট আরো তীব্র হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

বেসরকারি সংস্থা কোয়ালিশন ফর আরবানের নির্বাহী খন্দকার রেবেকা সানইয়াত বলেন, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। তারা আর্থিক সহযোগিতা পাচ্ছে, বিদেশ থেকে সাহায্যও পাচ্ছে। অনেক এনজিও তাদের সঙ্গে কাজ করছে। কিন্তু এ দেশের ছিন্নমূল মানুষ রোহিঙ্গাদের চেয়েও খারাপ অবস্থায় আছে। অতি কষ্টে ছিন্নমূল মানুষ জীবনযাপন করছে। বর্তমানে রাজধানীর ছোট-বড় বস্তিগুলোতে ৩৫ লাখ হতদরিদ্র মানুষ বসবাস করছে। এর মধ্যে ছিন্নমূল মানুষ রয়েছে অন্তত দুই লাখ। দীর্ঘসময় দুবার লকডাউনের মধ্যে পড়ে তারা খুবই মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে মানবিক সহায়তা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।

এদিকে করোনায় প্রতিদিনই শনাক্ত বাড়ছে, বাড়ছে প্রাণহানির সংখ্যা। এটি অর্থনীতি ও সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত সর্বাপেক্ষা বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে। কাজ হারিয়েছে লাখো মানুষ। চাকরিজীবী-শ্রমজীবী সবার আয় কমেছে। নিরুপায় হয়ে অনেকে শহর ছেড়ে গ্রামে চলে গেছেন। সর্বশেষ গতকাল শনিবার আক্রান্ত হয়ে রেকর্ড ৭৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে করোনায় মৃতের সংখ‌্যা দাঁড়াল ৯ হাজার ৬৬১ জনে।

Originally posted 2021-04-13 06:56:36.



Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked as *