নগদ অর্থ সংকটে যেসব ব্যাংক

সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটির মধ্যে ব্যাংকিং কার্যক্রম চললেও মহামারি করোনাভাইরাসের থাবা থেকে রক্ষা পায়নি অধিকাংশ ব্যাংক। ফলে চলতি বছরের প্রথমার্ধে অধিকাংশ ব্যাংকের মুনাফায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। নগদ অর্থ সংকটেও পড়তে হয়েছে কিছু ব্যাংককে।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন সময়ের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। তালিকাভুক্ত ৩০টি ব্যাংকের মধ্যে আগের বছরের তুলনায় মুনাফা কমেছে ১৭টির। এছাড়া লোকসানের মধ্যে নিমজ্জিত রয়েছে একটি ব্যাংক।

১৭টি ব্যাংকের ক্যাশ-ফ্লো ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। ক্যাশ-ফ্লো ঋণাত্মক হওয়া মানে নগদ অর্থ সংকটে পড়া। যে প্রতিষ্ঠানের ক্যাশ-ফ্লো যত বেশি ঋণাত্মক, ওই প্রতিষ্ঠানের নগদ অর্থের সংকটও তত বেশি।

বিশ্লেষক ও ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণ ছুটির মধ্যে ব্যাংক খোলা থাকলেও এপ্রিল, মে ও জুন মাসে আমদানি-রফতানিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। আমদানি-রফতানি বাণিজ্য কমে যাওয়ায় ব্যাংকের মুনাফায়ও বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

এছাড়া করোনার প্রকোপের কারণে এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে ব্যাংকে টাকা না রেখে নগদ অর্থ হাতে রাখার প্রবণতা দেখা দেয়। আবার বিতরণ করা ঋণের একটি অংশ আদায় হয়নি। সুদের হারও কমে গেছে। সবকিছু মিলিয়ে ব্যাংকের মুনাফা ও নগদ অর্থের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

তারা আরও বলছেন, অর্থনৈতিক কার্যক্রম সচল হওয়ায় আস্তে আস্তে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। যারা নগদ অর্থ কাছে রাখছিলেন, তারা আবার ব্যাংকমুখী হচ্ছেন। ফলে চলতি বছরের দ্বিতীয়ার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) বেশিরভাগ ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হতে পারে।

চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন প্রান্তিকে ক্যাশ-ফ্লো ঋণাত্মক অবস্থায় থাকা ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে- এক্সিম, এবি, ঢাকা, আইএফআইসি, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, আইসিবি ইসলামী, ন্যাশনাল, সাউথইস্ট, সিটি, এনসিসি, ওয়ান, ইবিএল, ইউসিবি, স্যোশাল ইসলামী, মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট, পূবালী ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক।

এর মধ্যে ক্যাশ-ফ্লো সবচেয়ে বেশি ঋণাত্মক অবস্থায় রয়েছে এবি ব্যাংকের। প্রতিটি শেয়ারের বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটির অপারেটিং ক্যাশ-ফ্লো বা পরিচালন নগদ প্রবাহ ৩৬ টাকা ৮১ পয়সা ঋণাত্মক অবস্থায় রয়েছে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা এক্সিম ব্যাংকের শেয়ারপ্রতি অপারেটিং ক্যাশ-ফ্লো ঋণাত্মক ১৪ টাকা ৫২ পয়সা। শেয়ারপ্রতি ঋণাত্মক ১৪ টাকা ২২ পয়সা অপারেটিং ক্যাশ-ফ্লো নিয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছে ইবিএল।

ক্যাশ-ফ্লো ঋণাত্মক হয়ে পাড়ার পাশাপাশি আইএফআইসি, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, ন্যাশনাল, সাউথইস্ট, সিটি, এনসিসি, ইবিএল, ইউসিবি, পূবালী ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের মুনাফাও আগের বছরের তুলনায় কমেছে। এছাড়া আইসিবি ইসলামী ব্যাংক বরাবরের মতো লোকসানের মধ্যে নিমজ্জিত রয়েছে।

ব্যাংকের এমন চিত্র সম্পর্কে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মুসা বলেন, ব্যাংক যে লোন দিয়েছে তা ফেরত আসেনি। খারাপ লোন বেশি দিয়েছে। এ কারণে হয়তো প্রভিশন বেশি করতে হয়েছে। এছাড়া সুদের হার কমানোর কারণেও আয় কমেছে। অপরদিকে, করোনার কারণে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য একপ্রকার বন্ধ ছিল। যা ব্যাংকের মুনাফায় বড় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। সবমিলিয়ে ব্যাংকের মুনাফা ও তারল্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সভাপতি ও ইবিএলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আলী রেজা ইফতেখার বলেন, করোনার কারণে ব্যাংকের মুনাফা ও ক্যাশ-ফ্লোতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, এটা খুবই স্বাভাবিক। কারণ, আমরা প্রায় তিন মাস লকডাউনে ছিলাম। গত এক-দুই মাস ধরে ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম বেড়েছে। একসময় আমরা প্রায় ৩০ শতাংশ ক্যাপাসিটি নিয়ে কাজ করেছি। এখন ৭০-৮০ শতাংশ ক্যাপাসিটি নিয়ে কাজ করছি। গত দেড়-দুই মাসে আমাদের অ্যাকটিভিটি আগের থেকে অনেক ভালো।

এবিবির সাবেক সভাপতি আনিস এ খান বলেন, ‘বেশিরভাগ ব্যাংকের ক্যাশ-ফ্লো ঋণাত্মক হওয়ায় ক্যাশ টাকা বেশি চলে গেছে। করোনার কারণে মার্চ মাস থেকে টাকা বাড়ির সিন্দুক, আলমারিতে চলে গেছে। মানুষ ভয় পেয়েছিল, ব্যাংকে যেতে পারবে না, খাবার টাকা তখন কীভাবে পাবে? সেজন্য বাসায় তুলে রেখেছিল। আমি নিজেও তুলে রেখেছি। এ কারণে ব্যাংকের ক্যাশ-ফ্লো ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। তবে এখন আবার মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখছে।’

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. বখতিয়ার হাসান বলেন, করোনার কারণে অনেকে কাজ হারিয়েছেন। আয় না থাকায় তাদের জমানো টাকা খরচ করতে হয়েছে। তাদের অনেকে ব্যাংক ডিপোজিট ভেঙেছেন। আবার ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা লোন ঠিকমতো রিকভারি হয়নি। সবমিলিয়ে ব্যাংকের ক্যাশ-ফ্লোতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

এদিকে ক্যাশ-ফ্লো পজিটিভ থাকলেও বেশ কয়েকটি ব্যাংকের মুনাফা আগের বছরের তুলনায় কমেছে। আবার মুনাফা আগের বছরের তুলনায় বাড়লেও ক্যাশ-ফ্লো ঋণাত্মক হওয়ার চিত্রও রয়েছে। গত বছরের তুলনায় মুনাফা কমে যাওয়া অন্য ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে- ব্র্যাক ব্যাংক, উত্তরা ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক ও মার্কেন্টাইল ব্যাংক।

এর মধ্যে মুনাফায় সবচেয়ে বেশি ঋণাত্মক প্রভাব পড়েছে ব্র্যাক ব্যাংকের। ব্যাংকটির মুনাফা আগের বছরের তুলনায় ৫৩ শতাংশ কমে গেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন সময়ে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয়েছে ৯৫ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ২ টাকা ২ পয়সা।

এবিবি সভাপতি ও ইবিএলের সিইও আলী রেজা ইফতেখার বলেন, প্রায় তিন মাস লকডাউনের মধ্যে থাকায় স্বাভাবিকভাবেই ব্যাংকগুলোর মুনাফা প্রথমার্ধে কম হবে। বিশেষ করে দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) প্রথম প্রান্তিকের থেকে কম হবেই। আমরা আশাবাদী, তৃতীয় ও চতুর্থ প্রান্তিকে ভালো ব্যবসা হবে। ২০১৯ সালের মতো না হলেও, আমরা সবাই চেষ্টা করছি কাছাকাছি যাওয়ার জন্য। কিন্তু এপ্রিল, মে ও জুন— এই তিন মাস আমরা অনেক পিছিয়ে গেছি।

মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, সুদের হার ১২ থেকে ৯ শতাংশ করা হয়েছে। এরপর করোনার কারণে আমদান-রফতানি বাণিজ্য কমে গেছে। সার্বিক বাজারে চাহিদাও কমে গেছে। সবমিলিয়ে আমাদের আয় কমে গেছে। কিন্তু ব্যয় কমেনি। আমরা বিভিন্নভাবে ব্যয় কমানোর চেষ্টা করছি। তবে কর্মীদের পেছনে ব্যয় বা অন্যান্য যে ব্যয়, তা রয়ে গেছে। সেজন্যই এ অবস্থা হয়েছে। আগামী ছয় মাস আরও বেশি চ্যালেঞ্জের হবে। আমার (ব্যাংক) যে বিনিয়োগ তা ফিরে আসছে না। আবার আমানতের বিপরীতে গ্রাহকদের সুদ দিতে হচ্ছে। এখন দেখা যাক, সেপ্টেম্বরের পরে কী হয়।

এবিবির সাবেক সভাপতি আনিস এ খান বলেন, ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণ ঠিক মতো আদায় হচ্ছে না। এটা মুনাফায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এছাড়া ব্যাংকের মুনাফার বড় অংশ আসে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য থেকে। করোনার কারণে আমদানি-রফতানি কার্যক্রম তো প্রায় বন্ধ ছিল।

এদিকে মহামারি করোনার কারণে বেশিরভাগ ব্যাংকের ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও ১২টি ব্যাংকের মুনাফা আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- এক্সিম, এবি, ঢাকা, ট্রাস্ট, ওয়ান, আল-আরাফাহ ইসলামী, ডাচ্-বাংলা, যমুনা, রূপালী, সোশ্যাল ইসলামী, মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ও ব্যাংক এশিয়া। ব্যাংকগুলোর মধ্যে এক্সিম, এবি, ঢাকা, ওয়ান, সোশ্যাল ইসলামী ও মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ক্যাশ-ফ্লো ঋণাত্মক অবস্থায় রয়েছে।

একটি ব্যাংকের শীর্ষ এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, করোনার কারণে চলতি বছরের প্রথমার্ধে সব ব্যাংকের মুনাফায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। অবশ্য এর মধ্যেও কিছু ব্যাংক ভালো ব্যবসা করেছে। তবে যে ১২টি ব্যাংকের প্রতিবেদনে মুনাফা বাড়ার তথ্য তুলে ধরা হয়েছে, তাদের মুনাফা প্রকৃত অর্থেই বেড়েছে নাকি, ম্যাকানিজম করে বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে, তা খতিয়ে দেখা উচিত।

এ বিষয়ে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. বখতিয়ার হাসান বলেন, যে ব্যাংকগুলোর মুনাফা বেড়েছে, তাদের গ্রাহক হয়তো ভালো ছিল। তাদের লোন রিকভারিও ভালো হয়েছে। তবে অনেক সময় কেউ কেউ অর্ধবার্ষিক হিসাবে মুনাফা বাড়িয়ে দেখানোর জন্য আর্থিক প্রতিবেদনে কিছু ম্যাকানিজম করে। যেমন- প্রভিশন কম দেখায়। আবার এমন কিছু মুনাফা আছে, যা এখন দেখানোর কথা নয়, তা-ও দেখায়। এমন করলে বছর শেষে নিরীক্ষিত প্রতিবেদনে মুনাফা কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

Originally posted 2020-08-12 19:29:07.



Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked as *