কোন দিকে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের পরিস্থিতি
ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেনের জয় মেনে নিতে নারাজ প্রেসিডেন্ট ডেনাল্ড ট্রাম্প। তিনি আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে জিততে চাইছেন। ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়াও আটকে রেখেছেন। সম্ভাব্য যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছেন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন শীর্ষ বেসামরিক কর্মকর্তাকে সরিয়ে নিজের বিশ্বস্ত লোককে বসিয়েছেন।
এদিকে নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প পরাজয় মানতে যে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন- সেটা বিব্রতকর। তবে কোনো কিছুই ক্ষমতা হস্তান্তর বন্ধ করতে পারবে না। দুই প্রধান রাজনৈতিক শিবিরের অনড় অবস্থানে যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচন পরবর্তী পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতি জন রবার্ট মঙ্গলবার ওবামাকেয়ার স্বাস্থ্য নীতি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে এক শুনানিতে বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিত্বকারীদের উদ্দেশে বলেন, ‘এসব বন্ধ করুন। কংগ্রেসের কাজ বিচারপতিদের করতে বলবেন না। রাজনৈতিক হাঙ্গামার মধ্যে আদালতকে টানবেন না। ’
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে ট্রাম্পের বিশ্বস্তদের বসানো হচ্ছে
গতকাল বুধবার সিএনএনের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রশাসন খুঁড়িয়ে চলা শাসনব্যবস্থার চরিত্র ধারণ করতে চলেছে। সেনাবাহিনীর ‘চেইন অব কমান্ড’ নষ্ট হচ্ছে। বিশ্বস্ততার পরীক্ষা চলছে। জো বাইডেন শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের আশা করছেন অথচ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং রিপাবলিকানরা পরাজয় মেনে নেননি। বাইডেন যখন মিত্র দেশের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছেন ট্রাম্প তখন দরজা বন্ধ করে একের পর এক বিভ্রান্তিমূলক টুইট করছেন। প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্ক এসপারকে সরিয়ে দেওয়ার পর বেশ কয়েকজন শীর্ষ বেসামরিক কর্মকর্তাকে সরিয়ে দিয়েছেন।
সিএনএনের আরেক খবরে বলা হয়েছে, মাত্র ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে পেন্টাগনের চার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে হয় বরখাস্ত করা হয়েছে নয়তো তারা পদত্যাগ করেছেন। তারা ট্রাম্পের নীতিনির্ধারণ ও গোয়েন্দা সংক্রান্ত বিষয়গুলো দেখভাল করতেন। তাদের জায়গায় ট্রাম্পের বিশ্বস্ত লোকদের বসানো হয়েছে। তাদের মধ্যে এমন একজন রয়েছেন যিনি সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যা দিয়ে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছিলেন। ট্রাম্পের এই পদক্ষেপের পর পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে পেন্টাগনের সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন।
খবরে বলা হয়েছে, মার্ক এসপারকে সরানোর পর পেন্টাগনে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টির আভাস পাওয়া যাচ্ছে। বাইডেনের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের সময়টা বিশৃঙ্খলাপূর্ণ করে জাতীয় নিরাপত্তা খর্ব করা হতে পারে বলে উদ্বেগ বাড়ছে। ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে যেসব শীর্ষ কর্মকর্তা কাজ করেছেন তারা প্রেসিডেন্টের আচমকা সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়টি জানেন। কিন্তু নির্বাচনের পর এক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা আরো বেড়েছে। এক প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা সিএনএনকে বলেন, এটি একটি ভীতিকর ও অস্থির পরিস্থিতি। ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্য থেকে নির্বাচিত ডেমোক্র্যাট নেতা ও হাউস আর্মড সার্ভিসেস এর চেয়ারম্যান অ্যাডাম স্মিথ এক বার্তায় বলেছেন, প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা হস্তান্তরের এই সময়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পদে যেভাবে রদবদল হচ্ছে তা খুবই বিপদজনক।
ক্ষমতা হস্তান্তর কার্যক্রম বন্ধ
জো বাইডেন এবং কমলা হ্যারিস দায়িত্ব গ্রহণের জন্য প্রস্তুতি শুরু করেছেন। কিন্তু নিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরে বিলম্ব ও বাধা সৃষ্টি করতে সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ট্রাম্প। ক্ষমতা হস্তান্তর আয়োজনের দায়িত্ব ফেডারেল প্রতিষ্ঠান জেনারেল সার্ভিস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (জিএসএ)। তারা এখনো বাইডেনকে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে রয়েছেন ট্রাম্পের পছন্দের কর্মকর্তা এমিলি মার্ফি। তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর কার্যক্রম আটকে করে রেখেছেন।
সিএনএন বলছে, অতীতে দেখা গেছে এসব প্রতিবন্ধকতার ফল ভালো হয় না। ২০০০ সালের নির্বাচনে জর্জ বুশের সময় ক্ষমতা হস্তান্তরে দেরি হওয়ায় জাতীয় নিরাপত্তা দল গঠনে দেরি হয়েছিল। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর হামলার ঘটনায় এটিকেও কারণ হিসেবে দেখা হয়। অলাভজনক প্রতিষ্ঠান পার্টনারশিপ ফর পাবলিক সার্ভিসের পরিচালক ম্যাক্স স্টিয়ার বলেন, বিশাল কর্মযজ্ঞ সামাল দিতে নব-নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে অনেক কাজ করতে হয়। তাই ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া নির্বাচনের দিন থেকেই শুরু হয়ে যায়। সেই বিবেচনায় বাইডেনের লোকজন ক্ষমতা হস্তান্তর পরিকল্পনার সঙ্গে সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন।
ম্যাক্স স্টিয়ার মনে করেন, ক্ষমতা হস্তান্তরে দেরি হলে জাতীয় ও জননিরাপত্তা হুমকিতে পড়তে পারে। নিরাপত্তার পাশাপাশি অর্থনীতিও চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে পারে। তবে কতদিন এই প্রক্রিয়া বন্ধ রাখা যাবে সেটা বলা কঠিন। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান অনুযায়ী ২০ জানুয়ারি দুপুরে নতুন প্রেসিডেন্টকে দায়িত্ব নিতে হবে। জো বাইডেন বলেছেন, সত্যি কথা বলতে কী কোনো কিছুই আমাদের থমকে দিতে পারবে না।
ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তার সহযোগীরা যা বলছেন
ট্রাম্প মঙ্গলবার বেশ কয়েকটি টুইট করেন। এসব টুইটে তিনি দাবি করেন, ভোট গণনায় ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে এবং আমরাই বিজয়ী হবো। তবে তার এসব টুইটকে ‘বিতর্কিত’ বলে লেবেল দিয়ে রেখেছে টুইটার। কারণ কোনো তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নির্বাচনে কারচুপির দাবি করছেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনুগত হিসেবে পরিচিত পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন, যখন প্রতিটি ‘বৈধ’ ভোট গণনা করা হবে, তখন ট্রাম্প প্রশাসনের দ্বিতীয় দফার মেয়াদ শুরু হবে। জো বাইডেনের বিজয়ী হওয়ার পূর্বাভাস স্বীকার করা থেকে নিজেদের সরিয়ে রেখেছেন ট্রাম্পের রিপাবলিকান পার্টির শীর্ষ নেতারাও। মঙ্গলবার উইসকনসিনের সিনেটর রন জনসন সাংবাদিকদের বলেন, জো বাইডেনকে অভিনন্দন জানানোর মতো কিছু এখনো ঘটেনি। সিনেটে শীর্ষ রিপাবলিকান নেতা মিচ ম্যাককনেল বলেছেন, পেনসিলভানিয়ার মতো ব্যাটেল গ্রাউন্ডগুলোর নির্বাচনের ফলাফল চ্যালেঞ্জ করার শতভাগ অধিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের রয়েছে।
ট্রাম্পের পরাজয় স্বীকার না করা বিব্রতকর : বাইডেন
এখন পর্যন্ত ট্রাম্পের সঙ্গে কোনো উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি করতে চাইছেন না বাইডেন। মঙ্গলবার ডেলাওয়ারের উইলমিংটনে তিনি বলেন, ট্রাম্পের পরাজয় স্বীকার না করা বিব্রতকর। যদি কৌশলের সঙ্গে বলতে হয়, আমার মতে এটা প্রেসিডেন্টের উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে কোন সাহায্য করবে না।
দায়িত্ব নেওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে ইতিমধ্যে বিদেশি নেতাদের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করতে শুরু করেছেন জো বাইডেন। মঙ্গলবার তিনি যুক্তরাজ্য ও আয়ারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট, জার্মান চ্যান্সেলরের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। এ বিষয়ে বাইডেন বলেন, আমি তাদের জানিয়েছি যে, আমেরিকা আবার ফিরে এসেছে। ইতিমধ্যে অনেক দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানরা বাইডেনকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। সর্বশেষ তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইপে এরদোয়ান।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এখনো আইনি লড়াইয়ে জেতার মতো ভিত্তি বা তথ্য-প্রমাণ দিতে পারেননি। অনেকেই মনে করছেন আদালতে তিনি সুবিধা করতে পারবেন না। ম্যাক্স স্টিয়ারের মতে, ট্রাম্প যদি নির্বাচনের ফল উল্টে দিয়ে আবার ক্ষমতায় বসেন তাহলে কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা হচ্ছে, রাষ্ট্রের স্বাভাবিক কাজে বাধা সৃষ্টি করা। রাষ্ট্রের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের প্রতিটি সিদ্ধান্ত জনগণের ওপর প্রভাব ফেলে। তাই এখন ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া নিয়ে জটিলতা প্রতিটি মার্কিনির জন্য উদ্বেগের বিষয়।ITF