২০ ফেব্রুয়ারি ছিল টেনশন বিদ্ধ দিন

১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। মিটিং-মিছিল, সমাবেশসহ সব রাজনৈতিক কর্মসূচি নিষিদ্ধ। এই ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে কি না, তা নিয়ে রাজনৈতিক নেতা ও ছাত্রনেতাদের মধ্যে নানা তর্কবিতর্ক চলতে থাকে। একপর্যায়ে ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভেঙে একুশের কর্মসূচি পালনেরই সিদ্ধান্ত হয়।

ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক তার একুশের দিনলিপি গ্রন্থে লিখেছেন, ঢাকার ছাত্রসমাজের জন্য ২০ ফেব্রুয়ারি হয়ে ওঠে একটি টেনশনবিদ্ধ দিন। একটি ঘোষণা গভীর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করে। মতভেদ তৈরি হয় ছাত্র যুবা ও রাজনীতিকদের মধ্যে। তখন বিকাল। সেক্রেটারিয়েট রোড ধরে এগিয়ে আসছে একটি ঘোড়ার গাড়ি, সামনে মাইক বাঁধা। ঢাকা তখনো রিকশা, ঘোড়ার গাড়ি ও মুড়ির টিন মার্কা টাউন সার্ভিস বাসের শহর। ঘোড়ার গাড়িটা ফজলুল হক হল, ঢাকা হল এলাকা পার করে মেডিকেল ব্যারাক বাঁয়ে রেখে সোজা চলে যায় সলিমুল্লাহ হলের দিকে। যেতে যেতে ঘোষণা-ঢাকা শহরে এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি। সভা-সমাবেশ, মিছিল নিষিদ্ধ। হুকুম ঢাকার মেজিস্ট্রেটের। বলতে হয়, মৌচাকে ঢিল। ভাসানীর ‘কথার কথা’ শেষ পর্যন্ত সত্যে পরিণত হলো।

ঘোষণা শুনে ছাত্রাবাসে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। আপাতত মেডিকেল ব্যারাক প্রাঙ্গণে স্লোগান ওঠে : ‘১৪৪ ধারা মানি না, মানি না’। কিছুক্ষণ পর অন্য ধারার আওয়াজ : ‘১৪৪ ধারা ভাঙব, ভাঙব’! পরে জানা যায়, আশপাশের ছাত্রাবাসগুলোয় একই মনোভাবের প্রকাশ। কিন্তু এ ঘটনা রাজনৈতিক নেতাদের বিষম বিপাকে ফেলে দেয়। সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদে তাদের প্রাধান্য। পরিষদেও সমস্যা। বিপাকের কারণ, সামনে সাধারণ নির্বাচন। এ অবস্থায় রাজনৈতিক নেতারা সরকারের সঙ্গে সংঘাতে যেতে চায় না, পাছে নির্বাচন বন্ধ হয়ে যায়। এসব বিচারে ছাত্রদের সঙ্গে জাতীয় নেতাদের মতভেদ। তাই ১৪৪ ধারা না মানা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে সে রাতেই সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের বৈঠক। পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচির কারণে ভাসানী ঢাকায় অনুপস্থিত। তাই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রবীণ জননেতা আবুল হাশিম। সভায় ১৪৪ ধারা ভাঙা নিয়ে তীব্র তর্কবিতর্ক। শেষ পর্যন্ত ১১/৩ (মতান্তরে ১১/৪) ভোটে সিদ্ধান্ত হয়, ‘১৪৪ ধারা ভাঙা হবে না’। এ সিদ্ধান্ত মূলত রাজনৈতিক নেতাদের, যেমন আবুল হাশিম, কামরুদ্দীন আহমদ, খয়রাত হোসেন, শামসুল হক এবং গোলাম মাহবুব, হেদায়েত হোসেন চৌধুরী প্রমুখ ছাত্র প্রতিনিধির। এর বিরুদ্ধে অর্থাৎ ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে ভোট দেন আবদুল মতিন, অলি আহাদ ও গোলাম মাওলা। সত্যি বলতে কী, নুরুল আমীন প্রশাসনের ভীত বা আতঙ্কিত হয়ে একুশের কর্মসূচি ঠেকাতে ১৪৪ ধারা জারি আন্দোলনকে আরও সুসংহত ও শক্তিমান হতে সাহায্য করেছিল। রাজনৈতিক নেতাদের পিছুটান সত্ত্বেও ছাত্রবাস থেকে ছাত্রাবাসে ক্ষুব্ধ ছাত্রদের একুশের কর্মসূচি পালনে স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের প্রকাশ ঘটে এবং তা ১৪৪ ধারার নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই।

Originally posted 2021-02-20 04:01:52.



Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked as *