
মিয়ানমারে আবারও সেনা অভ্যুত্থান, সু চি গ্রেফতার

মিয়ানমারের রাষ্ট্রপতি উইন মিন্ট ও ক্ষমতাসীন দলের নেত্রী অং সান সু চিকে গ্রেফতার করেছে দেশটির সেনাবাহিনী। সোমবার (১ ফেব্রুয়ারি) ভোরে সেনাবাহিনীর অভিযানে তাদের গ্রেফতার করা হয়। সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) এক মুখপাত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেন। এছাড়াও গ্রেফতার করা হয়েছে শাসক দলের শীর্ষ কয়েকজন নেতাকে।
রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ক্ষমতাসীন দল এনএলডির মুখপাত্র মায়ো নিউন্ট জানান, অং সান সু চি, রাষ্ট্রপতি উইন মিন্ট এবং অন্যান্য শীর্ষ নেতাদের সোমবার ভোরে গ্রেফতার করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি ও সুচি গ্রেফতার হওয়ায় আশঙ্কা করা হচ্ছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দেশটিতে জরুরি অবস্থা জারি করা হবে।
নিজেও গ্রেফতার হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি জানান, এখন যা ঘটছে, তাতে সামরিক বাহিনী অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করছে বলে আমরা আশঙ্কা করছি। এ সময় তিনি দেশটির নাগরিকদেরকে দ্রুত কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে আইন মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছেন।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজধানী নেপিডো ও প্রধান শহর ইয়াঙ্গুনের রাস্তায় রাস্তায় সেনারা টহল দিচ্ছে। প্রধান প্রধান শহরে মোবাইল ও ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। একই সঙ্গে আজ অনুষ্ঠিতব্য পার্লামেন্ট অধিবেশনও স্থগিত করা হয়েছে।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ও মিয়ানমারে অবস্থিত পশ্চিমা দেশগুলোর দূতাবাস দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার এ দেশটিতে সেনা হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা নিয়ে গভীর উদ্বেগ জানানোর একদিন পর শনিবার অভ্যুত্থানের আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে সংবিধান মেনে চলা ও আইন অনুযায়ী কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল দেশটির সেনাবাহিনী।
ঐ বিবৃতিতে মিয়ানমারে সেনাবাহিনী বলে, সংবিধানের বিলুপ্তি নিয়ে তাদের কমান্ডার ইন চিফের সাম্প্রতিক বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে। বাহিনীটি আইন অনুযায়ীই কাজ করবে। কিছু সংস্থা ও গণমাধ্যম তারা যা চায়, তাই ধরে নিয়েছে এবং লিখে চলেছে।
দেশটিতে নভেম্বরের নির্বাচনের পর বেসামরিক সরকারের সঙ্গে সেনাবাহিনীর বাড়তে থাকা উত্তেজনার মধ্যে আজ সোমবার থেকে নতুন পার্লামেন্টের যাত্রা শুরু হওয়ার কথা ছিল।
গত বছরের ৮ নভেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) বড় জয় পায়। সেনাবাহিনী সমর্থিত দল ইউএসডিপি ভোটে প্রতারণার অভিযোগ তুলে ফল মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায় এবং নতুন করে নির্বাচন আয়োজনের দাবি তোলে। দাবি মানা না হলে সেনাবাহিনী ফের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় বসতে পারে বলেও ইঙ্গিত দেয় তারা।
যে কারণে সু চিকে গ্রেফতার
অং সান সুচির এনএলডি গত ৮ নভেম্বরের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু দেশটির সেনাবাহিনী নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ তোলে। ধারণা করা হচ্ছে, নির্বাচন নিয়েই সু চিকে গ্রেফতার করা হলো।
সামরিক বাহিনী নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তোলার পর থেকে দেশটিতে সামরিক অভ্যুত্থানের শঙ্কা দেখা দিয়েছিল।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সামরিক বাহিনী নির্বাচনের ফলকে বাধাগ্রস্ত করেছে। তারা সুপ্রিম কোর্টে দেশটির প্রেসিডেন্ট এবং ইলেক্টোরাল কমিশনের প্রধানের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছে।
সোমবার (১ ফেব্রুয়ারি) ভোরে সেনাবাহিনীর অভিযানে মিয়ানমারের রাষ্ট্রপতি উইন মিন্ট ও অং সান সু চিকে গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতারের পর দেশটির মিলিটারি টিভি নিশ্চিত করে যে, দেশটিতে এক বছরের জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। সোমবার সামরিক বাহিনী জানায়, তারা ক্ষমতা কমান্ডার-ইন-চিফ মিন অং লাইংয়ের কাছে হস্তান্তর করছে।
কে এই অন সাং সু চি
মিয়ানমারের রাষ্ট্রপতি উইন মিন্ট ও ক্ষমতাসীন দলের নেত্রী অং সান সু চিকে গ্রেফতার করেছে দেশটির সেনাবাহিনী। সোমবার (১ ফেব্রুয়ারি) ভোরে সেনাবাহিনীর অভিযানে তাদের গ্রেফতার করা হয়। সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) এক মুখপাত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেন। এছাড়াও আটক করা হয়েছে শাসক দলের শীর্ষ কয়েকজন নেতাকে।
অং সান সু চি বার্মিজ ভাষায় যার উচ্চারণ আওঁ সাঁ সু চি। তিনি বর্মী রাজনীতিক, কূটনীতিক, এবং লেখিকা যিনি মিয়ানমারের প্রথম ও বর্তমান রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা এবং ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসির নেত্রী। তিনি দেশটির ডি ফ্যাক্টো তথা অনানুষ্ঠানিক প্রধান হিসেবেই ব্যাপকভাবে পরিচিত। এছাড়াও প্রথম নারী হিসেবে সু চি মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রী, রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের মন্ত্রী, বিদ্যুৎশক্তি ও ক্ষমতা বিষয়ক মন্ত্রী, এবং শিক্ষা মন্ত্রী হিসেবে প্রেসিডেন্ট টিন চাঅয়ের কেবিনেটে কাজ করেন।
আধুনিক মায়ানমারের জাতির জনক অং সান এবং খিন চির কন্যা সু চির জন্ম হয় ব্রিটিশ বার্মার রেঙ্গুনে। ১৯৬৪ সালে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় ও ১৯৬৮-তে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় হতে স্নাতক অর্জন করার পর তিনি জাতিসংঘে তিন বছর কাজ করেন। ১৯৭২ সালে মাইকেল অ্যারিসকে বিয়ে করেন এবং তাদের দুই ছেলে হয়। ১৯৮৮-র গণআন্দোলনের সময় সু চি সবার নজর কাড়েন এবং ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসির (এনএলডি) সাধারণ সম্পাদক হন; সেসময় সদ্যগঠিত দলটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সামরিক জান্তার বিরোধী অবসরপ্রাপ্ত কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা।
সু চির দল ২০১০ সালের নির্বাচন বয়কট করে, যা সেনাসমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টিকে তাৎপর্যপূর্ণ বিজয় এনে দেয়। ২০১২ সালের উপনির্বাচনে তিনি সংসদের নিম্নকক্ষের এমপি নির্বাচিত হন এবং তার দল ৪৫টি ফাঁকা আসনের মধ্যে ৪৩টিতে জয়লাভ করে। ২০১৫ সালের জাতীয় নির্বাচনে তার দল ভূমিধ্বস বিজয় অর্জন করে, অ্যাসেমব্লি অব দি ইউনিয়নের (সংসদ) ৮৬ শতাংশ আসন অর্জন করে; যদিও প্রেসিডেনশিয়াল ইলেকটোরাল কলেজে তাদের প্রার্থীকে রাষ্ট্রপতি ও দ্বিতীয় উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচনের জন্য ৬৭ শতাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাই যথেষ্ট ছিল। সু চির প্রয়াত স্বামী ও সন্তানেরা বিদেশি নাগরিক হওয়ায় সংবিধান অনুসারে তিনি রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন না। তাই তিনি নবপ্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা পদটি গ্রহণ করেন যা কিনা প্রধানমন্ত্রী বা সরকারপ্রধানের সমান। গণতন্ত্র ও মানবতার পক্ষে সংগ্রামের জন্য তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার (১৯৯১) সহ আরো অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছেন, যদিও রোহিঙ্গা সংকট প্রসঙ্গে তার ভূমিকা তীব্রভাবে সমালোচিত।
Originally posted 2021-02-01 15:54:01.