পথে পথে করোনা ঝুঁকি, ঈদযাত্রায় উপেক্ষিত স্বাস্থ্যবিধি

ঈদুল আজহা উপলক্ষে বাস, লঞ্চ ও ট্রেনে ঘরমুখো যাত্রীসংখ্যা বাড়ছে। গত কয়েক দিনের তুলনায় বুধবার রাজধানীর টার্মিনালগুলোয় মানুষের পদচারণা ছিল বেশি। এদিন সরেজমিন দেখা গেছে, ফেরি যাত্রীদের বেশির ভাগেরই মাস্ক ব্যবহার ও সামাজিক দূরত্ব মেনে বসতে অনীহা ছিল। এমনকি মাস্ক খুলে গল্প করা, খাবার খাওয়া ও ঘোরাঘুরি করেছেন অনেকেই।

অপরদিকে সড়কপথে বাসের এক সিট ফাঁকা রেখে আরেক সিটে যাত্রী বসলেও কেউ কেউ মাঝপথে মুখ থেকে মাস্ক খুলে রাখেন। রাজধানীতে চলাচলকারী অনেক বাস রিজার্ভে দূরপাল্লার রুটে যাওয়ার সময়ে এক সিট ফাঁকা রাখার বিধান মানছে না।

বৃহস্পতিবার (৩০ জুলাই) অফিস-আদালত ছুটির পর যাত্রীচাপ আরও বাড়বে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে পথে পথে করোনাভাইরাস সংক্রণের ঝুঁকি বাড়ছে বলেও আশঙ্কা তাদের।

পরিবহন শ্রমিকরা জানিয়েছেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণ ও বন্যার প্রকোপ এবার ঈদযাত্রার আনন্দ কেড়ে নিয়েছে। বিগত যে কোনো ঈদের তুলনায় যাত্রীসংখ্যা অনেক কম।

মানুষ ঈদ উৎসবের চেয়ে অনাগত ভবিষ্যতের আর্থিক সংকট নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। কেউ কেউ চাকরি হারিয়ে বা আর্থিক অসচ্ছলতার কারণেও ঢাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।

জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, মানুষের এভাবে যাতায়াত গ্রামে করোনাভাইরাস সংক্রমণ আরও বাড়াবে। এসব মানুষ যখন ঢাকায় ফিরবেন, তখন ঢাকায়ও সংক্রমণের তীব্রতা বাড়বে। গত ঈদের তিক্ত অভিজ্ঞতা এ কথাই বলছে।

তিনি বলেন, মানুষের নিজের মধ্যে সচেতনতা আনতে হবে। ঘরের বাইরে বের হলেই পুরো সময় মাস্ক পরে থাকতে হবে। কিছু সময়ে মাস্ক পরবেন, কিছু সময় পরবেন না তা হবে না। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। জনগণকে মনে রাখতে হবে, সুরক্ষা নিজের জন্য।

করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঝুঁকি থাকায় যাত্রীদের সতর্কভাবে চলাচলের আহ্বান জানিয়েছেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। অতি প্রয়োজন না হলে ঈদযাত্রা না করারও অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।

বুধবার নৌ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ দফতর ও সংস্থাগুলোর সঙ্গে বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিপত্র (এপিএ) স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে তিনি এ আহ্বান জানান।

এক প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, লঞ্চ টার্মিনালে জীবাণুনাশক টানেল স্থাপন করেছি এবং তাপমাত্রা পরিমাপের ব্যবস্থা করা হয়েছে। লঞ্চ মালিকরাও ব্যবস্থা নিয়েছেন।

সব থেকে বড় কথা হচ্ছে- লঞ্চের নকশা করোনার জন্য স্বাস্থ্যসম্মত নয়। আমরা যাত্রীদের বিনীত অনুরোধ করব- ডেকের যাত্রীদের জন্য যে মার্কিং করে দেয়া হয়েছে, সেটা যেন মেনে যাতায়াত করেন।

তিনি বলেন, আমরা তো কখনও কল্পনা করিনি এ ধরনের ছোঁয়াচে রোগ আসবে। তবে ভবিষ্যতে যখন নতুন লঞ্চের অনুমোদন দেয়া হবে, তখন ছোঁয়াচে রোগ প্রতিরোধের বিষয়গুলো দেখা হবে।

বন্যা আরও বেশি হলে নৌযান চলাচলে কোনো সমস্যা হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, যত বেশি পানি হবে, নৌকা তত ভাসবে। তীর ভাঙা বা ফেরি চলাচলে সাময়িক অসুবিধা হলে সেটা দ্রুত ঠিক করা হবে।

দেশের দক্ষিণাঞ্চলের নৌযাত্রীদের যাতায়াতের অন্যতম মাধ্যম ঢাকা নদীবন্দরে গিয়ে দেখা যায়, এ বন্দরে ৭টি জিবাণুনাশক টানেল থাকলেও বুধবার তা সরিয়ে নেয়া হয়েছে।

তবে প্রবেশপথগুলোয় যাত্রীদের মাস্ক আছে কি না, তা মনিটরিং করা হচ্ছে। যাদের মুখে মাস্ক নেই, তাদের বিনামূল্যে মাস্ক সরবরাহ করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)।

এছাড়া যাত্রীদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে যাত্রা করতে মাইকিং করা হয়েছে। কিন্তু বুধবার ঢাকা থেকে বরিশালসহ বিভিন্ন রুটে ছেড়ে যাওয়া সুন্দরবন-১২, সুরভী-৯, কর্ণফুলী-১৩, কুয়াকাটা-২, মানিক-২সহ বেশ কয়েকটি লঞ্চের ডেকে যাত্রীরা সামাজিক দূরত্ব বজায় না রেখে যাত্রা করছেন।

অনেকেরই মুখে মাস্ক নেই। জটলা পাকিয়ে গল্প করতেও দেখা গেছে।

এসব লঞ্চে যাত্রীদের সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে লাল রঙের চিহ্ন এঁকে দেয়া হয়েছে। যাত্রী বাড়ার সঙ্গে লঞ্চের সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে। মঙ্গলবার সদরঘাট থেকে ৮২টি লঞ্চ ছেড়ে গেছে।

বুধবার ওই সংখ্যা আরও বেড়েছে। বৃহস্পতিবার লঞ্চের সংখ্যা একশ’র কাছাকাছি হতে পারে বলে জানিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ।

সুন্দরবন-১২ লঞ্চে বরিশালের বানারীপাড়া যাচ্ছেন আকলিমা বেগম, তার স্বামী সিরাজুল ইসলাম ও দুই সন্তান। তাদের কারও মুখেই মাস্ক নেই। লঞ্চে বসে খাওয়াদাওয়া করছেন।

করোনা ঝুঁকির কথা বলতেই অনেক খ্যাপে যান সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, করোনার কারণেই জুনে গার্মেন্ট থেকে তাদের ছাঁটাই করা হয়েছে। অনেক ঘুরেও চাকরি পাননি।

তাই টিকতে না পেরে ঢাকা শহর ছেড়েই চলে যাচ্ছেন। কুয়াকাটা-২ লঞ্চের যাত্রী আরিফুর রহমান বলেন, লঞ্চের ভেতরে দাগ দেয়া আছে ঠিকই। কিন্তু ওই দাগ অনুযায়ী বসলে কয়জন যাত্রী যেতে পারবে?

লঞ্চের স্টাফরাই গাদাগাদি করে যেতে বলছে। যদিও এ অভিযোগ অস্বীকার করে লঞ্চ মালিকরা বলছেন, গল্পগুজব করতে যাত্রীরা পাশাপাশি বসে যাতায়াত করছেন।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক বলেন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে যাত্রীদের উদ্বুদ্ধ করছি, মাইকিং করছি। অনেক ক্ষেত্রে তারা তা মানছেন, অনেক ক্ষেত্রে মানছেন না। সেক্ষেত্রে তাদের ওপর বল প্রয়োগ করাও সম্ভব হচ্ছে না।

জিবাণুনাশক টানেল উঠিয়ে দেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যাত্রীদের সঙ্গে শিশুও থাকে। তাদের শরীরে জিবাণুনাশক পানি ছিটালে ক্ষতি হতে পারে- এমন শঙ্কায় সেগুলো সরিয়ে ফেলতে বলা হয়েছে। তবে প্রবেশ গেটে যাদের মুখে মাস্ক নেই, তাদের মাস্ক সরবরাহ করা হয়েছে।

অপরদিকে সড়কপথে বাসে একটি আসন ফাঁকা রেখে আরেক আসনে যাত্রী বহন করছে পরিবহন কোম্পানিগুলো। ঈদের দুইদিন সামনে রেখেও পর্যাপ্ত যাত্রী পাচ্ছেন না। কাউন্টারগুলো অনেকটাই ফাঁকা।

যাত্রীর অভাবে হানিফ, সোহাগ, শ্যামলী, নাবিলসহ কোম্পানিগুলো তাদের বাসের অর্ধেকও চালাচ্ছেন না। তবে যাত্রী কম থাকলেও করোনাভাইরাস আক্রান্তের ঝুঁকিতে পড়ছেন পরিবহন শ্রমিকরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক চালক ও সুপারভাইজার বলেন, বাস ছাড়ার পড় অনেক যাত্রী মুখের মাস্ক খুলে রাখেন। গাড়ির ভেতরে খাওয়াদাওয়া করেন। মাস্ক খুলে হাঁচি দেন।

তারা জানান, বর্তমানে পথে যাত্রাবিরতি না দেয়ার অজুহাত তুলে যাত্রীরা এসব কর্মকাণ্ড করেন। এতে করোনায় আক্রান্ত কোনো যাত্রী এমন আচরণ করলে বাকি সব যাত্রী, চালক ও সুপারভাইজার আক্রান্তের শঙ্কায় পড়ছেন।

অনেক শ্রমিক ইতোমধ্যে আক্রান্ত হয়েছেন। অপরদিকে যাত্রী কম থাকায় মালিকরাও ট্রিপ কমিয়ে দিচ্ছেন। চালক-হেলপারের আয় কমে গেছে। অপরদিকে কম ভাড়ায় লোকাল বাসগুলো স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই বেশি যাত্রী বহন করছে।

এতেও ঝুঁকি বাড়ছে। এ বিষয়ে সোহাগ পরিবহনের মালিক ফারুক তালুকদার সোহেল বলেন, যাত্রীসংখ্যা এত কমে গেছে যে মঙ্গলবার ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ছেড়ে যাওয়া এসি বাসে যাত্রী ছিল ৬ জন।

কক্সবাজার ও বেনাপোল রুটের সব এসি গাড়ি বন্ধ। বুধবার ঢাকা থেকে খুলনার বাসে ১৩ জন যাত্রী গেছেন, এসেছেন ৪ জন। এমন পরিস্থিতিতে নন এসি বাসের ২৫ শতাংশ ও এসি বাসের ১৫ শতাংশ গাড়ি চালাচ্ছি।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, দূরপাল্লার রুটে রাজধানীতে চলাচলকারী লোকাল বাস চলার কথা নয়।

কিন্তু কেউ যদি রিজার্ভ করে নিয়ে যায় এবং স্বাস্থ্যবিধি না মেনে যাত্রী বহন করে তবে ওই গাড়ির চালক ও মালিক দায়ী। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এসব দেখা উচিত। এদিকে রেলওয়ে জানিয়েছে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে ট্রেনে যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে। প্রতিদিন ১২টি ট্রেনে ৪ হাজার ৮৫৪ জন যাত্রী বহন করা হচ্ছে।

বাকি আসন খালি রেখে ট্রেন চলাচল করছে। সামনের দিনে এভাবেই চলবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা শওকত জামিল যুগান্তরকে বলেন, প্রতিটি ট্রেন গন্তব্যে পৌঁছার পর জিবাণুনাশক স্প্রে করা হচ্ছে। যাত্রীদের মাস্ক পরে যাত্রা করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। সূত্র : যুগান্তর

Originally posted 2020-07-30 20:45:19.



Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked as *